বিজ্ঞাপন দিন

নিষ্ঠুর নিয়তি | নাঈমুল হাসান


 
১. পরমানন্দপুর সবুজে ঘেরা একটি গ্রাম। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা নদী মেঘনা। রাস্তার চারপাশের সারি সারি গাছগুলো ফলের ভারে নতজানু হয়ে পরমানন্দপুরকে করেছে অনুপমা। তেমনই দিগন্তবিস্তৃত সুজলা সুফলা ফসলের মাঠ গ্রামটিকে করেছে আরো সুন্দর। গ্রামটিতে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই রয়েছে, কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু নেই একটি আদর্শ মাদ্রাসা। পুরো গ্রাম জুড়ে একটি মাত্র মক্তব থাকলেও তা মাদ্রাসার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়। জনগণ পরামর্শে বসলো; বর্তমানে একটি মাদ্রাসার খুব প্রয়োজন, এই বিষয়ে সকলেই একমত। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ালো জায়গা নিয়ে। মাদ্রাসার জন্য জমি কে দেবে? জায়গার ব্যাপারটা নিমিষেই সমাধা হয়ে গেল এনামুল হাসান সাহেবের মাধ্যমে। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাবন্দি করেন। তার চেয়ে বড় কথা হলো তিনি মাদ্রাসা প্রিয়। গ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার ভুমিকাটাই সবচে বেশি। রাস্তার পাশের পছন্দের জায়গাটা মাদ্রাসার জন্য ওয়াকফ করে দিলেন। পাশাপাশি তার এবং গ্রামের অন্যান্যদের আন্তরিক সহযোগিতায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই আবাদ হয়ে গেল মাদ্রাসা। কুরআনের পাখিদের গুঞ্জনে মুখরিত থাকে ইলমের এই ছোট্ট বাগানটি।


২. ঈদুল আযহা দরজায় কড়া নাড়ছে। তাই গ্রামের মানুষের মনে এক অন্যরকম আনন্দ বিরাজ করছে। সকলেই আসন্নঈদকে কেন্দ্র করে নানা কাজে ব্যাস্ত। ঈদুল আযহার বিরতি দেওয়া হলো। মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্খী হিসেবে প্রতিষ্ঠানের চাবি জমা রাখা হলো এনামুল হাসান সাহেবের কাছে। তিনি খুশীমনে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সময় চললো আপন গতিতে, ঈদের আমেজ শেষ হলো; যথারীতি খোলা হলো মাদ্রাসা। তখনই ঘটলো অঘটন। বলা-কওয়া নেই, মাদ্রাসার অনেকগুলো টাকা চুরি হয়ে গেল। সবাই হতবাক। মাদ্রাসার সাথে সংশ্লিষ্ট গ্রামের সবাই একত্রিত হলো, সবার মন একটাই প্রশ্ন। দীর্ঘ আলোচনার পর আঙুল ওঠল চাবি ওয়ালার ওপর। চুরি করার জগন্য অপবাদটি চাপিয়ে দেয়া হলো এনামুল সাহেবের ওপর। যার প্রাণপণ চেষ্টায় মাদ্রাসার অস্তিত্ব, প্রতিটি ইটে লেগে আছে যার মহানুভবতার ছোঁয়া। বিস্ময়ে স্রেফ হতবাক হয়ে গেলেন তিনি, লজ্জায় তার মাথা নিচুহয়ে গেল। কাঁদতে চেয়েও তিনি কাঁদতে পারছেন না সম্ভবত কাঁদার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। গ্রামের মানুষদের এমন নিষ্ঠুরতায় তিনি অনেক ব্যথিত হলেন। গ্রামে আর এক মুহূর্তও থাকলেন না। ভিটেমাটি ছেড়ে দুই ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে পাড়ি জমালেন ঢাকায়।


৩. এক বছর পর টাকা চুরির আসল রহস্য উন্মোচিত হলো মাদ্রাসার কাজে নিয়োজিত এক মিস্ত্রী টাকাটা চুরি করেছিলো। সে একসময় অনুতপ্ত হয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তা ফিরিয়ে দেয়। পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল এ ঘটনা। সব জায়গায় আলোচনা হতে লাগাা এনাম সাহেবের ব্যাপারটা। তাহলে চোর ভেবে যাকে তারা অপমানিত করেছে..? প্রশ্নটা সবার মনে কাঁটার মতো বিদ্ধ হতে লাগলো। এনাম সাহেবের সাথে এমন আচরনে সবাই লজ্জিত হলো, কিন্তু তখন অনেক কিছু বদলে গিয়েছিলো। এদিকে পরিবারকে ঢাকায় রেখে মনে চাপা কষ্ট নিয়ে এনাম সাহেব দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান নতুন কর্মক্ষেত্রের খোঁজে। কী সীমাহীন কষ্ট ও দুঃসহ আঘাত নিয়ে ভিটেমাটি ছেড়েছেন ও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তা হয়তো গ্রামের মানুষেরা অনেক পরে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। হয়তো পরবর্তীতে বোধোদয় হয়েছিল তাদের। কিন্তু এই উপলব্ধি কিংবা বোধোদয় দিয়ে তো আর নিয়তি বদলানো যাবে না।

2 মন্তব্যসমূহ

আপনার মন্তব্য লিখুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

নবীনতর পূর্বতন