শৈশব কাল; মানবজীবনে সুখ-দুঃখ মিশ্রিত স্মরণীয় একটি সময়। আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে খুব আবেগ প্রবণ হয়ে সময়টাকে স্মরণ করতে দেখি। কেউ সময়টাকে স্মরণ করে খুশিতে বাগ বাগ হয়ে যায়। আবার কেউ অতীতের দুঃখ-কষ্টে পূর্ণ সময়টাকে ভুলে থাকতে চায়।
কারো সময়টা কেটেছে গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশে ছোটাছুটি করে, খাল-বিলে ঝাঁপাঝাঁপি করে, গাছের ডাল থেকে ডালে লাফালাফি করে। কেউ ই বা খেয়ে না খেয়ে অভাব অনটনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে বহু কষ্টে জীবন যুদ্ধের একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর কিছুমানুষ সময়টা পার করেছে শহুরে অস্বস্তিকর পরিবেশে বদ্ধ খোঁয়ারে জীবনবিধ্বংসী আধুনিক মরণাস্ত্র মোবাইল কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থেকে। এসব রোবটদের আলোচনা করে সময়ক্ষেপণ করার কোন অর্থই হয় না। কারণ এদের অভিধানে শৈশবকাল শব্দটিই নেই। এ শৈশবের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর এক একটি আমার কাছে রূপকথার গল্পের মত। সুখ-দুঃখের অনুভূতি মিশ্রিত এ মুহূর্তগুলো আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়।
আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি দেশীয় সুজলা সুফলা পরিবেশে অতিবাহিত করা এ রঙিন স্বপ্নীল মুহূর্তগুলোর কথা শুনে। বিধাতা আমার অদৃষ্টে এ আনন্দঘন মুহূর্তগুলো উপভোগ করা লিখে রাখেননি। সুযোগ হয়নি আমার শৈশবের পাখি হয়ে দেশভর উড়ে বেড়াবার। শৈশব আমার কেটেছে দেশের মাটি থেকে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার বালু-সমুদ্রের এক দেশে। যেখানে চারদিকে ধুঁ ধুঁ মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে গেলেও চোখে পড়ে না একবিন্দু জীবনের ছোঁয়া। সেখানে নেই আমাদের দেশের মত ঘন জনবসতি, নেই সবুজ-শ্যামলে ঢাকা বিস্তীর্ণ অরণ্য, নেই চারদিক থৈথৈ করা খাল-বিল, নদী-নালা, আর নেই আমাদের দেশের মত পানির এত স্বচ্ছলতা।
যদিও সে দেশে জীবন-যাপন করার জন্য আধুনিক সরঞ্জামাদির প্রাচুর্যতার কোন সীমা নেই। প্রশস্ত রাস্তায় আমাদের দেশের মত এত যানজট, ট্রাফিকের অবাধ্যতা, হর্ণের পর হর্ণের আওয়াজ ইত্যাদি জাতীয় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় না। সেখানকার সবাই আপনাপন গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করে, যার দরুণ রাস্তায়ভারী যানবাহন তেমন একটা চোখে পড়ে না, যা-ও চলাচল করে তাদের রাস্তা সম্পূর্ণই ভিন্ন। আর সে দেশের জনসংখ্যা কত! যে দেশের মোট আয়তনের একটা সিংহভাগ বালুতে ঢাকা। এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে এ মরুভূমির বালু সমুদ্রের মুখ না দেখে উপায় নেই।
তবে বালু সমুদ্রের দর্শন লাভ করার জন্য অন্য কোন শহরের পথ ধরতে হবে বিষয়টা সে রকমও নয়। দালানকোঠায় ঘেরা শহুরে এলাকা থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলেই অসহ্যকর লু-হাওয়ার মাধ্যমে সংবর্ধনা জানান এ মরুভূমি সাহেব, ঠাঁটা পড়া রোদ তো আছেই। যতদূর চোখ যায় খোদায়ী নিদর্শন বালুর ঢেউ ছাড়া আর তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। বালু সমুদ্রের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা ক্যাক্টাস জাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বখোঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এরা যে কিভাবে জনশূণ্য নাজুক পরিবেশেবেঁচে থাকে তা রাব্বে আজীমের এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত। এ মরুভূমির মাঝে বালুর কিছু চলমান পাহাড়ও দেখা যায়। যেগুলো সাইমুমের সাথে তাল মিলিয়ে স্থানান্তরিত হতে থাকে। আর সে সাইমুম বিশালকায় বালুর পাহাড়গুলোকেএক জায়গা থেকে উঠিয়ে অনত্র বসিয়ে দিতে পারে। যা কিছু ভয়ংকর সাইমুমের থাবায় পড়ে, নীলাকাশের নিচে তার অস্তিত্বের কতটুকু যে অবশিষ্ট থাকে তা বলাই বাহুল্য। এ বালু সমুদ্রের অন্যতম আকর্ষণীয় আরেকটি বস্তু হলো মরুজাহাজ, যার ব্যাপারে স্বয়ং রাব্বে আজীম পবিত্র কালামে এরশাদ করেন, “তারা কি (মরুজাহাজ) উটকে দেখে না কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?” (সূরা গাশিয়াহ, আয়াত; ১৭)।
দিন হোক বা রাত; ঝড় তুফান থাক বা প্রবল রৌদ্রতাপ,তাদের একমাত্র আবাসস্থল এ বালুসমুদ্র। মরুভূমিতে জন্মানো বৃক্ষ আর পাথরই এদের একমাত্র জীবন ধারণের মাধ্যম। তাদের পিঠের প্রাকৃতিক ফিল্টার দিগ্বিদিক শুন্য পানিহীন মরুপ্রান্তরে দিনের পর দিন পানির যোগান দিয়ে যায়। এ প্রাণীগুলো আল্লাহপাকের সৃষ্টির কত বড় বিস্ময়কর উদাহরণ, তা মানুষের পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
সাধারণত আমরা আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোতে দেখে থাকি আরবদের পোশাক-আশাকের জৌলুসতা। শীত নেই গরম নেই, সবসময় তাদের অবয়ব আচ্ছাদিত থাকে অস্বাভাবিক ধরনের ভারী কাপড়-চোপড়ে। বালুময় উত্তপ্ত আবহাওয়ায় আলখাল্লার মত মোটা ভারী জুব্বা, মাথায় রুমাল, তার ওপর কালো চাকার মত বীড়া, চোখে কালো চশমা ইত্যাদি আরো কত কি! যেন বেশ-ভূষারজাঁকজমকতার কোনো অন্ত নেই! কিন্তু যদি তাদের দিক থেকে পোশাক-আশাকের দিকে লক্ষ্য করা হয়, তাহলে এ ধরনের পোশাক ছাড়া জনজীবনে মানুষের অস্তিত্ব বিনষ্ট হওয়ার প্রবল আশঙ্কা মাথাচারা দিয়ে ওঠবে। কারণ ঐ দেশের লু-হাওয়াটা খুবই অসহ্যকর। যার মধ্যে আমাদের দেশীয় পাতলা কাপড়-চোপড় পরে থাকা, অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ার নামান্তর। আর চোখ-মুখকে রৌদ্রতাপ ও বাতাসে উড়তে থাকা বালুকণা থেকে বাঁচিয়ে না রাখলে চেহারা সুরত এবং দৃষ্টিশক্তিকে খোদার ফয়সালার উপর ছেড়ে দিয়ে যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকতে হবে।
আমার শৈশবের সবচেয়ে বড় একটা পাওয়া হলো বারংবার হারামাইন শরীফের জিয়ারত লাভ। রাব্বে কারিমের মহান দরবারে লাখো কোটি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি যে, আমার জন্মস্থান স্বরূপ নবী স. এর দেশকে নির্বাচিত করেছেন। অগণিতবার খোদায়ী রহমতের ছায়াতলে ও নববী পরশের ছোঁয়ায় ধন্য হওয়ার তৌফিক নসিব হয়েছে। যা আমার গোটা জীবনের মধ্যে স্মরণীয় বরণীয় মুহূর্ত। আমার জীবনের এক মহান সফলতা আর সৌভাগ্য। এর পাশাপাশি জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস হল আগের মত এত সহজে এত সময় নিয়ে মন ভরে বাইতুল্লাহ ও রওজায়ে আতহারকে দেখার সুযোগ পাবো না। কোনদিন সে সোনালী দিনগুলোর আবার মুখোমুখি হতে পারব কিনা তার কোন নিশ্চয়তানেই, শুধুমাত্র একটাই কামনা:
“তৌফিক মোরে দিও ওগো মহা মহীয়ান,
তোমার ঘরের যিয়ারতে হয়ে যাব আমি দেওয়ান।
মুহাজির নবীর পথ ধরে আমি হব আগুয়ান,
নববী পরশে ধন্য কর মোরে ও রহিম রহমান।”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন