বিজ্ঞাপন দিন

পানামের পানে দ্বীন প্রচারের ফাঁকে ইতিহাস দর্শন | জুনায়েদ বিন আমীন



আজ বৃহস্পতিবার দরসের চাপ তেমন নেই। মুসলিহে উম্মাহ শায়খ সন্দ্বীপি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান মাদানীনগর এর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন জামাত ২৪ ঘন্টার তাবলীগের কাজে বের হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এই সপ্তাহে আমাদের জামাতের পালা। তাই যোহরের আগে সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাদ যোহর মাওলানা জাকারিয়া সাহেব দামাত বারকাতুহুম হেদায়েতী কথা বললেন এবং প্রভাবান্বিত কিছু নসিহত করলেন। যা মানব জীবনের প্রতিটি পদে পদে কাজে আসার মত।

বয়ান শেষে সকলে একত্রিত হলাম। রুখ ছিল সকলের কাছে অজানা। কিছুক্ষণ পর সোনারগাঁর কথা শুনে মনটা নেচে উঠলো। চোখে মুখে বিরাজ করলো এক অজানা অনুভুতির অভিব্যক্তি। ইতোপূর্বে কখনো সেখানে যাওয়া হয়নি। আল্লাহ তা'আলা অপ্রত্যাশিতভাবে এমন একটি সফরের ব্যবস্থা করে দিবেন ভাবতেও পারিনি। কিছুক্ষণ পর সকলে দোয়া করে বেরিয়ে পড়লাম কাঙ্খিত গন্তব্যের পথে। চলতে লাগলাম মুখে জিকির আর অন্তরে উম্মতের ফিকির নিয়ে। পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম বাসস্ট্যান্ডে। একে একে সকলে উঠে বসলাম স্ব আসনে। কিন্তু তালেবে এলেম বেশি হওয়ার দরুন জায়গা সংকুলান হল না। তাই নববী আদর্শ বুকে লালনকারী কয়েক সাথী দাঁড়িয়ে রইলেন (জাযাকুমুল্লাহ খাইরান)। অপরদিকে বাস চলছে আপন গতিতে। রাস্তা দু'ধারের সৌন্দর্যেঘেরা দৃশ্য গুলো অবলোকন করতে করতে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত পানাম নগরে। বাস থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম মসজিদ পানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মসজিদের ধারে। প্রবেশের পূর্বে আমির সাহেব কিছু নসিহত করে খোলা আকাশের নিচে দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন। আল্লাহর দরবারে কিছুক্ষণ রোনাযারীর পর আসরের সালাত আদায় করলাম। এরপর হলো দাওয়াতী গাশতের আমল। আমল শেষে দেওয়া হল ইনফিরাদী কাজের সুযোগ। এই সুযোগে সকলেই মুক্ত বাতাসে শান্ত পরিবেশে প্রমোদভ্রমনে বের হলাম। মসজিদ থেকে কিছুদূর যেতে দৃশ্যমান হলো পানামের ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনাগুলো।

২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই নগরী। সোনারগাঁও লোক ও কারু শিল্প জাদুঘর থেকে উত্তর দিকে এটি। হাঁটাপথে ছিল ৭২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫.৫ প্রস্থের একটি পুল। এই পুল পেরিয়েই পানাম নগর। এবং নগর চিরে চলে যাওয়া পানাম সড়ক। যার দুই ধারে সারি সারি একতলা ও দ্বিতল বাড়ি। এসব অবলোকন করছিলাম। ঠিক তখন স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ঐতিহাসিক সোনালী অতীত। এ-ই তো সেই সোনারগাঁ, যেখানে ১৫ শতকে ঈসাখাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।

পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদী পথে বিলেত থেকে আসত বিলাতী থানকাপড়, দেশ থেকে থেকে যেত মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়ত পালতোলা নৌকা। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন উপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে পানাম নগরী। পরবর্তীতে এখানকার পোশাক বাণিজ্যের স্থান দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। বর্বর ইংরেজরা এখানে বানিয়ে বসেছিল নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র।

জেমস লেটর বলেছেন, সোনারগাঁর একটি প্রাচীন শহর ছিল পানাম। এই তত্ত্বটির সাথে বাস্তবের কোন বিরোধ নেই। শহরটিতে উপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা বাড়ি রয়েছে প্রচুর। যার বেশিরভাগ বাড়ি আঠারো শতকের। (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের নামফলক রয়েছে।) মূলত পানাম ছিল বাংলার সেই সময়কার ধনী ব্যবসায়ীদের বসতকেন্দ্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিল ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই করে তুলেছিল এই নগর।

১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানীর সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পানাম পুল (যা বিলুপ্ত) ও দুলালপুর পুল এবং পানামনগর সেতুর অবস্থান ও তিনদিকের খাল বেষ্টনীতে বোঝা যায় পানাম ছিল সোনারগাঁর একটি উপশহর। বাংলার স্বাধীন রাজা ঈশাখাঁর পদচরণা ছিল এই নগরীতে। সুলতানি আমল থেকে এখানে বিকশিত ছিল বাঙালী সংস্কৃতি। 

পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২ টি বাড়ি ছিল উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১ টি আর দক্ষিণ পাশে ২১ টি বাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলোর অধিকাংশ উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, উচ্চতা ১ তলা থেকে ৩ তলা। ভবনগুলোর মধ্যে উপনিবেশবাদী ছাড়াও মুঘল এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকৌশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। 

বেশিরভাগ বাড়ির চারদিকের মধ্যস্থ স্থানটিতে রয়েছে উন্মুক্ত উঠান। নগরীর পানি সরবরাহের জন্য রয়েছে দু'পাশে দুটি খাল ও পাঁচটি পুকুর। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আছে কুয়া বা কূপ। ভিতরে আবাসিক এলাকা ছাড়াও রয়েছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, পান্থশালা, চিত্রশালা। এছাড়াও আছে ৪০০ বছরের পুরনো টাকশাল বাড়ি।

এসব পরিদর্শন করতে করতেই মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের সমধুর কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হল মাগরিবের আজান। তাই কাল বিলম্ব না করে ছুটে গেলাম মসজিদের দিকে..


জুনায়েদ বিন আমীন 

মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

নবীনতর পূর্বতন