বলছিলাম ২০১৫ সালের কথা। আমি যখন হেফজখানায় পড়ি। তখন একটা বিষয় আপেক্ষিক ছিল আমার জন্য। তা হলো বিশ্ব ইজতেমা। হেফজখানার কয়েকজন বড় ভাই ইজতেমায় শরিক হতেন। আমি তখন ছিলাম ছোট। যে কারণে পারিবারিকভাবে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তবে যখন ইজতেমার পর মাদ্রাসা খোলা হত, যারা ইজতেমায় গিয়েছে তারা ইজতেমার বিভিন্ন কাহিনী এমন ভাবে বলতো যে, শুনে আমার খুব আফসোস লাগত। আর মনে মনে ভাবতাম যদি আমিও ইজতেমায় যেতে পারতাম। এরপর একসময় পরিবার থেকে অনুমতি পেয়ে গেলাম। সে যে কি আনন্দের মুহূর্ত ছিল তা প্রকাশ করার কোনো শব্দ আমার জানা নেই।
ইজতেমায় আমার প্রথম গমন– প্রস্তুতি নিলাম ইজতেমার জন্য। আসরের পর জামাত বেরিয়ে পড়লো। বাসে ওঠার পর দেখি সবাই সিটে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার চোখে কোনো ঘুম নেই। কারণ আমি বসে তখন শুধু ইজতেমার দৃশ্যপট কল্পনা করছি, আর ভাবছি কখন গিয়ে হাজির হব আমার সেই স্বপ্নের জায়গায়। সময় যেন কিছুতেই কাটছিল না।
অবশেষে রাত দু'টায় গিয়ে পৌঁছলাম। বাস থেকে নেমে দেখি বিশাল ময়দান। যা আমি আগে কখনোই দেখিনি। গেইটের ভেতর যাব– তখন অচেনা এক ব্যক্তি (বয়স প্রায় ৭০ বা ৮০ হবে) বললেন, বাবা আমার মোবাইলে এত এত যে নাম্বার আছে, এটা আমার ঘরের নাম্বার। আমি কল দিতে পারি না। তুমি একটু কল দিয়ে বলে দিতে পারবে আমি ইজতেমায় এসে পৌঁছেছি? আমি কল দিয়ে বলে দিলাম। উনার পরিবার থেকে আমাকে বলল, 'উনার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। মাঝে মাঝে হুঁস ঠিক থাকে না'। মনে মনে ভাবলাম ইজতেমার প্রেমে মাতাল এমন ব্যক্তিও বুঝি আছে!
তারপর ভিতরে চলে গেলাম। সব ঠিকঠাক করে ঘুমাতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। ক্লান্ত শরীর ঘুমে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আযানের ধ্বনি কানে আসা মাত্রই উঠে ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। নামাজের পরপরই আমার ও এবং আমার সাথী ফরহাদের চিন্তা ছিল পুরা ইজতেমার মাঠ ঘুরে ঘুরে দেখব। এমন সময় আমির সাহেব বললেন, 'তোমরা যারা ছাত্র আছ তারা সাধারণ মানুষদেরকে কোরআন মাশক্ করাও। তখন আমাদের উভয়ের মেজাজ খারাপ হলেও মাশক করাতে বসলাম। আমার কাছে দেওয়া হল আমাদের এলাকার তিনজন মুরুব্বীকে আমি উনাদেরকে সুরা ফাতেহার মাশক্ করালাম। একজন মুরুব্বীকে বললাম, 'আপনি সুরা ফাতেহাটা বলুন তো'। তিনি আমাকে যা শোনালেন তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন...(আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম। মালিকি ইয়াওমিদ্দীন।) ঠিক এভাবেই। আমি সরাসরি ওনার ভুল না ধরে বললাম, মুরুব্বী আমার সুরা ফাতেহাটা ঠিক হয় কিনা দেখেন তো। সরাসরি ভুল ধরলে লোকটা বিব্রত হত। তারপরও দেখলাম লোকটা সেই আগের মতই পড়ছে। তখন আমার খুব আফসোস লাগলো। আহ! এমন বয়স্ক লোক নামাজে কী পড়ে তাহলে? তার এই অবস্থা দেখে সাথে সাথে আমার মনে হল নিজ পরিবারের কথা। না জানি তাদের কোরআন পড়ার অবস্থা কেমন? বিষয়টি আমার মনে আগে কখনো আসেনি। তারপর ওনাদের মাশক্ করাতে থাকলাম। ভুলেই গেলাম আমাদের ঘোরাঘুরির সেই অহেতুক কাজটার কথা। এখন চেষ্টা করলাম কিভাবে তাদেরকে কোরআন শেখানো যায়। এভাবে উজতেমার শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে তাদেরকে মাশক্ করাতাম। এটুকু সময় কি আর তাদের কোরআন শেখানো সম্ভব!
ক্ষুন্ন হৃদয়ে ফিরলাম ইজতেমা থেকে। আমার সামনে যদি এই বিষয়টা প্রকাশ না পেত তাহলে এই অনুভূতি আমার কখনোই হতো না যে, একজন ব্যক্তি মুসলিম হয়েও সুরা ফাতেহা পারে না। খোঁজ নিলে দেখবেন, আমাদের মা, বাবা, দাদা, ভাই, বোন অনেকেরই কোরআন সহিহ-শুদ্ধ না। আমরা কি কখনো তাদেরকে বলেছি? সুরা ফাতেহাটা আমাকে শুনান তো! আমাদের উপর কি তাদের কোন হক্ব নেই! অন্যথায় আমরা মাদ্রাসায় পড়ে কি লাভ হলো! বাহিরের খেদমত তো দূরের কথা, আমি তো আমার পরিবারের প্রতিও বেখেয়াল। এজন্য কি আমাদের আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে না?
অতঃপর আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম— ইনশাআল্লাহ! আমি আমার পরিবারকে এবং সর্বসাধারণকে ইসলামের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিখাব এবং জানাবো। আপনিও করুন এমন কল্যাণময় প্রতিজ্ঞা। তাহলে একটা সময় প্রত্যেকটা ঘরে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়বে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমীন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন