১.
একটু আগেই লাল সূর্যটা পশ্চিম আকাশে খসে পড়েছে। পাখিরা সব ফিরে গেছে আপন নীড়ে। উত্তপ্ত প্রকৃতি ঠান্ডা হয়ে এসেছে ধীরে ধীরে। দল বেঁধে চারদিক থেকে ছুটে আসছে অন্ধকারের দল। ভয়াল অন্ধকার। গাঢ় হয়ে আসছে রাতের পরিবেশ। স্তব্ধ প্রকৃতি। পাতাগুলো নিশ্চল হয়ে আছে একদম। আকাশের গায়ে ফুটে উঠেছে অগণিত তারা। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে নিঝুম সন্ধ্যা। রাস্তায় কমে এসেছে মানুষের আনাগোনা। এই সময়টাতেই আব্বুর ফিরে আসার কথা। আমি আর আম্মু বদ্ধ দুয়ারে আব্বুর একটি করাঘাতের অপেক্ষায় সেই কখন থেকে বসে আছি; একটানা, একঘোরে।
২.
আজ ৫ই মে। ফজরের পর থেকেই শুরু হয়েছে আব্বুর দারুণ ব্যস্ততা। হেফাজতে ইসলাম চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ঢাকায় সমবেত হচ্ছে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতা। অধিকারচর্চার নামের রসূলের শানে নাস্তিক-ধর্মবিদ্বেষীদের গোস্তাখীর একটা বিহিত হবে। সরকারকে দেওয়া হবে কড়া বার্তা। শুনেছি, আব্বুও নাকি যাবেন সেখানে। আব্বু আমাদের মহল্লা-মসজিদের ইমাম। এলাকার মুসল্লিদের তিনি গাইড দিয়ে নিয়ে যাবেন ঢাকায়। এ সুবাদে ফজরের আগে থেকেই মহল্লার মসজিদে জমা হচ্ছে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। আব্বু তার পুরাতন ডায়েরিটা খুলে টুকে রাখা বিভিন্ন নাম্বারে কল করছেন।
সে সময় আমার বয়স ছয় কি সাত হবে। এত কিছু বুঝতে শিখিনি তখনও। এদিকে সকাল থেকেই বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডা আবহাওয়া। আব্বু ফোনের কাজ শেষ করে খেয়ে দেয়ে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আব্বুকে আজ অন্যরকম লাগছে। গায়ে ধবধবে সাদা জুব্বা, মাথায় কালো পাগড়ি, কপালে শক্ত করে বাঁধা হেফাজতে ইসলামের সাদা-কালো ব্যাজ। রওনা দেওয়ার আগে আব্বু আমার কপালে চুমু খেলেন। তারপর আম্মুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে পড়লেন। মসজিদের মুসল্লিদের নিয়ে রওনা দিলেন ঢাকা অভিমুখে।
৩.
রাত এখন গভীর। চারদিকে অন্ধকার চেপে আছে পাষাণের মত। সময় প্রায় বারোটা। নিস্তব্ধ রজনী। বাইরের ঝিঁঝি পোকার পর্যন্ত সাড়াশব্দ থেমে গেছে। বাতাস নেই। নেই তিরতির করে নেচে ওঠা পাতাদের শব্দ। আমি আর আম্মু বসে বসে আব্বুর অপেক্ষা করছি। ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আব্বুর জন্য। কোনো দিন এত রাত পর্যন্ত আব্বুকে বাইরে থাকতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। উদ্যোগ আর উৎকণ্ঠা ঘিরে ধরেছে চারদিক থেকে। আম্মু কোনো কথা বলছেন না। নিশ্চুপ,নিঃশব্দ। জিজ্ঞেস করলেই শুধু বলছেন দুআ করতে। আম্মুর চেহারাটা ফ্যাকাশে লাগছে। এলাকার অনেকের কাছ থেকেই শোনা গেছে সরকার নাকি হেফাজতের উপর শকুনের চোখ ফেলে রেখেছে। ঘটলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে।
সন্ধ্যার দিকে এদিক-ওদিক থেকে টুকটাক খবর আসছিল, পুলিশ আর ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতার মধ্যে অনেক স্থানে নাকি ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়েছে। এতে অনেকে আহত হয়েছে। নিহতের খবরও শোনা গেছে দু-একটা। আব্বু বলেছিলেন, আন্দোলন শেষ করে এশার আগেই ফিরে আসবেন। এদিকে এলাকার একজনের কাছে জানতে পারলাম, খবর পাওয়া গেছে সকলকে শাপলা চত্বরে যেতে বলা হয়েছে। সেখানেই সকলে আজ রাত অবস্থান করবে। কে বলেছে? কারা বলেছে? তা জানা না থাকলেও একটা গুঞ্জন উঠেছে, সকলকে শাপলা চত্বরে যেতে হবে। এভাবেই এদিক-সেদিক থেকে টুকটাক খবর আসছিল। বোঝার আর বাকি থাকল না যে, ধীরে ধীরে অবস্থা ঘোলাটে হয়ে আসছে। খারাপ কিছু একটা ঘটবে। বাসায় কোন স্মার্টফোন না থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে আর কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। মানুষের কাছ থেকে যা শুনেছি, তার ওপরে নির্ভর করতে হচ্ছে। আম্মু বারবার আব্বুকে ফোন দিতে থাকেন। আব্বুর ফোন বন্ধ।
এভাবে ভয় ও শঙ্কায় সময় পার হতে থাকে। আর পৃথিবীর বুকে ভর করতে থাকে নিশিরাতের অন্ধকার। আমি আর আম্মু আব্বুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষা করতে করতে রাত এখন গভীর। নিঝুম।
৪.
আমি আর আম্মু খাটের ওপর পাশাপাশি বসা ছিলাম। দুজনেই নিশ্চুপ। কোনো কথা নেই। ঘরময় বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। বাইরে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। রাত এখন একটা বিশ। হঠাৎ! একেবারেই হঠাৎ!! চারপাশের নীরবতা ভেঙে দরজায় করাঘাত ঠক্ ঠক্ ঠক্। আমি আর আম্মু তো লাফিয়ে ওঠার উপক্রম। আম্মু শশব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নামেন। ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। এদিকে আমি খাটের এক কোণে একটা কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছি।
আম্মু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আমার দিকে তাকান। তারপর আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে দেন। তাকিয়ে দেখি আব্বু!!! এক দৌড়ে আব্বুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমি। আম্মু একপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। আব্বুর হাতে ২৫০ গ্রাম মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতল। অন্য হাতে একটা পাউরুটি। আব্বুকে দেখে দুশ্চিন্তা একেবারেই কেটে গেছে। আনন্দে আত্মহারা আমি খেয়াল করলাম, এরই মধ্যে আম্মুর চোখ থেকে ঝরে পড়েছে ক’ফোঁটা আনন্দাশ্রু। তৎক্ষণাৎ আঁচল দিয়ে মুছে নিয়েছেন। আবার মনে পড়ে, সে রাতে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিলাম আমি। আর মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম আর কোথাও যেতে দেব না আব্বুকে। যদি হারিয়ে যায় আব্বু। যদি আবার কখনো ফিরে আসতে এমন দেরি করে।
৫.
শাপলার ইতিহাস আমাদের ভোলা যাবে না। শাপলা আমাদের চেতনা। শাপলা আমাদের ইন্তিফাদা। সে রাতে ভাগ্যের টানে আব্বু ফিরে আসলেও ফিরে আসেনি আমার আব্বুর মত অনেক মানুষ। সে রাতে স্বৈরাচার সরকার পাখির মত গুলি করে মেরেছে অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে। রক্তাক্ত করেছে শাপলার চত্বর। রক্তে রক্তে ভেসে গিয়েছে শাপলার প্রতিটির বালুকণা। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে স্বৈরাচার বাহিনীর গুলির আওয়াজে। মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করেছে দিগ্বিদিক। এই ছোটাছুটির মধ্যে কেউ পান করেছে শাহাদাতের অমিত পেয়ালা। কেউ আহত হয়ে বরণ করে নিয়েছে আজন্ম পঙ্গুত্ব।
বর্তমানে শাপলার ইতিহাসের কথা বাদই দিলাম। শাপলা নামে আদৌ একটা চত্বর আছে কি নাই, তাও বাংলার অনেক মানুষের অজানা। শাপলা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে শরীরের রক্ত মাংসের মত। শাপলার ইতিহাস মোছা যাবে না। আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই ইতিহাস। চিরায়ত হোক শাপলার ইতিহাস। চির অমর হয়ে থাকুক শাপলার শহীদেরা...।
.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন