Responsive Advertisement

কায়রো বিমানবন্দরে কিছু সময় | আরাফাত


 আমি আমার গল্পটি শুরু করছি কায়রো বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মধ্য দিয়ে। সফরটি ছিল আমার উমরা সফরের একটি অংশ। স্বাভাবিক উমরা সফরের ট্রানজিট এ রকমই হয়, প্রত্যেকেরই পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয় এক নতুন ভূমির সাথে। ক্ষণিকের এই সাক্ষাৎ কারও জন্য হয় দু-এক ঘণ্টার আবার কারও জন্য আরও কম। খুব অল্প সময়েই ফিরতে হয় কাক্সিক্ষত ভূমির উদ্দেশে। কিন্তু ক্ষণকালের এই সাক্ষাৎ কুরআনের ঐতিহ্য সংবলিত ধূলিময় এই শহরের প্রতি তৈরি করে তীব্র আকর্ষণ আর সীমাহীন কৌতূহল। হৃদয় মিনারায় উঁকি দেয় রোমাঞ্চকর এই শহরে আবার ফিরে আসার প্রবল আকাক্সক্ষা। তবে পবিত্র ভূমির সাক্ষাতের জন্য উন্মুখ হৃদয়ের সামনে যেন এ সকল কিছু ম্লান হয়ে ধরা দেয়। 


ঠিক তেমনি হল আমার বেলায়, সফরে যাওয়া ও আসার পথে পরিচিত হলাম ঐতিহাসিক নগরীর সাথে। সেই প্রাচীন নাম সকলেরই জানা- ‘কায়রো’। যা পিরামিডের নগর নামেও পরিচিত। এটা মিশরের সর্বাধিক প্রাচীন নগর। শুধু আজ বা একশত বছর পুরোনো নয় এই নগর, বরং এর পরিচিতি তো সেই নবী স. এর যুগের পূর্ব থেকেই। যেখানে বহু নবী-রসূলের আগমন ঘটেছে। এ শহরের সাথে নবীগণের রয়েছে স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস- যেমনি কালোত্তীর্ণ তেমনি রোমাঞ্চকর ও বীরত্ব সর্বস্ব। যুগের স্রোত যেভাবে বয়ে গেছে, নবীগণের আগমন ও একের পর এক হারিয়ে গেছে। মুসা আ. এর আগমনে যেভাবে আল্লাহ তা’আলা সেই যুগে মিশরের শাসক ফেরাউনকে ধ্বংস করেছেন। ঠিক ইউসুফ আ. এর আগমনে আল্লাহ তা’আলা বাতিলকে দূর করে তাঁকে সেই দেশের শাসক বানিয়ে তাঁর দ্বীনকে সমুন্নত করেছেন। 


রাত আটটায় ঢাকা থেকে কায়রোর উদ্দেশে আমরা যাত্রা শুরু করি। সে রাতটা ছিল ১০ই রমজানের রাত। দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার ক্লান্তিকর সফরের মধ্য দিয়ে আমরা ‘কায়রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে’ পৌঁছাই। মোবাইলের স্ক্রিনে অটো টাইম জোন সাপেক্ষে সেট হয়ে গিয়ে মিশরের সময় - রাত একটা—জানান দিচ্ছে। বাংলাদেশের সময় থেকে চার ঘণ্টা ব্যবধান। বিমান পরিপূর্ণ স্থির হলে সকলেই নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কারও প্রস্তুতি ছিল এতটাই ছটফটে, যেন তারা সিঁড়ি ছাড়াই নেমে যাবে। প্রথমবারের মত কোনো দেশে কিছু সময় অবস্থানের আনন্দ-প্রফুল্লতা আর কৌতূহল যেন আমার সবচে’ বেশি। 


দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা সফরের ক্লান্তি আর ঘুমের কারণে শরীর যেন লাউয়ের ডগার মত নুয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু ঐতিহাসিক এই ভূমির অসামান্য আকর্ষণ সকল ক্লান্তিকে মরু-ধূলির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। একে একে সবাই নামছে। প্রত্নতাত্ত্বিক এই নগরীর সাক্ষাৎ লাভের আনন্দ সবার চোখে মরুভূমির বালুকা রাশির মতই চকচক করছে। সবাই যেন গেয়ে উঠতে চাচ্ছে- ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মোর চোখ হাসে...’। 


বিমানের এটেনডেন্টরা সবাইকে বিদায়ী সম্ভাষণ জানাচ্ছে। অবশেষে এলো সেই শুভক্ষণ, আমার সামনের ব্যক্তি নামল, আমি প্রথম সিঁড়িতে পা রাখা মাত্রই এক হিমেল হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে দিল। যে হাওয়ার তরজমা করলে অর্থ দাঁড়ায়- ‘স্বাগত হে! তোমাকে প্রত্নতাত্ত্বিক এই নগরীতে, মুসা নবীর দেশে, ইয়াকুব পুত্র ইউসুফের দেশে স্বাগতম।’ বিশাল জায়গাজুড়ে বেষ্টিত ময়দানে এক আশ্চর্যশীতলতা বিরাজ করছে। 


পূর্ব থেকেই দুটি বাস আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় আমি আর আমার সাথীদের একজন মুয়াল্লিমের অপেক্ষা করছিলাম। ইতোমধ্যে একটি বাস ছেড়ে গেছে। অপর বাসটি হয়তো আমাদের অপেক্ষা করছে। পরবর্তী সময়ে এক কর্মকর্তা এসে আমাদের নিয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত আমি চালকের পাশে আসন পাই। যেন একে একে রহস্যের ভেদ উন্মোচন হচ্ছিল। 


বাস্তবিক অর্থে মিশরকে তখন আমার দ্বিমুখী সাপের মত মনে হচ্ছিল, এপাশে চাকচিক্যময় আধুনিক নগর, অপর পাশে প্রাচীনত্বের অলিন্দে ঘেরা। আমি চালকের পাশে বসে বিমানবন্দরের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। ভেতরে ঢুকতেই হালকা ঠান্ডা অনুভব হল, বাস্তবে এ অনুভূতির বিষয়টি বুঝতে পারলাম না। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম মুয়াল্লিমের। তিনি আসলেন এবং সকলে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করামাত্রই কর্মকর্তাদের একজন আমাদের কাফেলার মাঝে এসে বলতে লাগলেন- আইনা মুদির? আইনা মুদির? পরে উনি আমাদের মুয়াল্লিমের সাথে কথা বলে প্রয়োজন সারতে বললেন। 


আমাদের এই ট্রানজিটে মাত্র ৫০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। আমাদের একটা বড়োসড়ো কক্ষ দেখিয়ে দেওয়া হল, আমরা প্রয়োজন সেরে সেখানেই ইহরাম বাঁধলাম। একটা বিষয় সে সময় আমার খুব অবাক লাগছিল, কক্ষে কয়েক জায়গায় ‘সিগারেটের বক্স’ রাখা, বিষয়টা সত্যিই দুঃখজনক। ইহরাম বাঁধার মত পবিত্র জায়গায় এমন ব্যবস্থা!! সেখান থেকে বের হয়ে পাশেই নামাজের একটি স্থানে ইহরামের নামাজ আদায় করলাম। একদল মুসাফির অঝোরে অশ্রু ঝরাচ্ছিল মোনাজাতে। আফসোস, তাদের মত এভাবে অশ্রু ঝরানোর সৌভাগ্য আমার হয়নি। 


নামাজে থাকা অবস্থায় ডাক আসল- ‘জেদ্দা, জেদ্দা’। মনের গহীনে কোথায় যেন আশ্চর্যপুলক অনুভব করলাম। সারা দেহজুড়ে যেন এক পবিত্র শিহরন বয়ে গেল। পুরো সত্তা জুড়ে তখন অনুরণিত হচ্ছিল একটাই বাক্য- ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা’। জগতের সবকিছুই তখন আমার কাছে তুচ্ছ। নামাজ শেষে ইমিগ্রেশন পর্ব ক্ষান্ত করে বাসে উঠে রওনা হলাম বিমানের দিকে। আর সেই বিমানে করেই ছুটলাম মূল গন্তব্যে। 


২৫ রমজানুল মুবারক, রাত তিনটার দিকে ১৫ দিনের সফর শেষে মদিনা থেকে আবার মিশরের কায়রোতে পৌঁছলাম। দেড় ঘণ্টার সফর ছিল এটি। সেহরীটা বিমানেই করেছিলাম। বিমান থেকে নামলাম। আসার সময় যে শীতল বাতাস অনুভব করেছিলাম, এবারে সেটার উল্টোটা অনুভবে ধরা দিল। বুঝতে পারলাম, তখন মিশরে শীতের শেষ ধাপ চলছিল। এখন হয়তো গ্রীষ্মের অনুকূলে প্রকৃতি ধাবিত হচ্ছে। 


বিমানবন্দরে পূর্বের ন্যায় নিচ তলা থেকে লিফটে চড়ে চলে এলাম তৃতীয় তলায়। তখন পড়লাম বিপদে, কোন পথ দিয়ে যাব? কীভাবে যাব? সেটা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ পথ ছিল কয়েকটা। একটা পথ এমন ছিল যেন, তার শেষটা কোন পর্যন্ত ঠেকেছে সেটাই বুঝতে পারা দায়। আমাদের সাথীরা সকলেই সোজা পথে হাঁটা শুরু করল, আমিও অনুসারী হয়ে গেলাম। 


পথিমধ্যে একটা নামাজের স্থান পেয়ে সেখানে ঢুকে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। যখন বের হলাম দেখি যে, সাথীরা যে পথ ধরে চলছিল সে পথেই প্রত্যাবর্তন করছে। খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার চলে আসলেন যে?’ তারেক নামের এক ভাই যিনি আলিম ছিলেন; তিনি বললেন, ‘পথ হারিয়ে ফেলেছি। হয়তো অন্য পথে আমাদের গন্তব্য।’ সে সময় সাধারণ সিকিউরিটি গার্ডের ড্রেস পড়া একজন অতিক্রমকালে তারেক ভাই তাকে গন্তব্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে ভিনদেশি বুঝতে পেরে ইংরেজিতে পথ কোথায় বলেছিলেন তিনি। উনার বলার পর আমি চিনে ফেললাম। তবে তারেক ভাই বুঝতে সমস্যা হল। তিনি তাকে আরবিতে বলতে বললেন। তখন তিনি বুঝতে পারলেন। অতঃপর তিনি নামাজে চলে গেলেন। আর আমি একাই পথ চলতে লাগলাম। 


হাঁটছি আর বড়ো বড় মার্কেটের দেয়ালে বিশাল আকারে টানানো মিশরের পর্যটন স্থানগুলোর ব্যানার দেখছি। পথিমধ্যে একজন আমাকে কিবলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, আমি তাকে ইশারায় জানিয়ে দিলাম। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘ সময় লাগিয়ে পৌঁছলাম ইমিগ্রেশনে। সামান্য কিছুক্ষণ বসতে না বসতে ডাক আসল। তারা দীর্ঘ সময় ধরে ইমিগ্রেশন কার্যসম্পাদন করল।


এটাই ছিল এ দেশের সর্বশেষ। কীভাবে যে দু’ঘণ্টা চলে গেল ভাবতেই পারলাম না। বিমানে ওঠার অপেক্ষায় রইলাম। শহরটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। যখন প্রথম এসেছিলাম তখন পুরো সময়টা ছিল রাত, আর এখন চলে আসার সময়টা সকাল। কিছু সময়ের মধ্যেই সূর্যের কিরণে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে পড়ল বিমানবন্দরে। আমরা একে একে উঠে বসলাম বিমানে। সূর্যের কিরণে পুরো দেশ আলোকিত। এখন অপেক্ষা শুধু এক ঝলক দেখার। অবশেষে বিমান আকাশ পানে উঠতে শুরু করল। মরুভূমির বালুকা রাশি যেন নিচ থেকে চকচক করছিল। বড়ো বড় মসজিদ ও সুন্দর সুন্দর সড়ক এবং বিরানভূমি পুরো স্পষ্ট দেখাচ্ছিল। এভাবেই বিমানটি প্রাচীন শহরের সামান্য দেখা দিয়ে মিশে গেল মেঘের সাথে, হারিয়ে গেল আকাশ পানে...

মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

নবীনতর পূর্বতন