বিজ্ঞাপন দিন

বাবা | মুহিব্বুল্লাহ তামীম


এক সুন্দর বিকেলে নদীর পাড়ে বসে দিগন্ত রাঙিয়ে দেওয়া সূর্যটার ডুবে যাওয়া দেখছিলাম। হঠাৎ মনে হল কেউ কাঁদছে। কিন্তু, আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। একটু পর আবার সেই আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি– একটা ছেলে খানিকটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একটু কাছে যাওয়ার পর, ছেলেটি আমাকে দেখামাত্র চোখ-মুখ মুছে সেখান থেকে চলে গেল। কৌতূহলী হয়ে ছেলেটার পিছু নিলাম। পরে জানতে পারলাম ছেলেটি গ্রামের এক মাদরাসায় পড়ে। এতটুকু জেনেই ঐ দিন বাড়ি ফিরলাম। 

পরের দিন একই ঘটনা আবার ঘটলে ছেলেটির মাদরাসায় যাই। এক ছাত্রকে ছেলেটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে চুপচাপ চলে যায়। আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, তার সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু জানেনা। তবে নাম আলভী। পৃথিবীতে আপন বলতে শুধু বাবাই আছে। এ কথা শুনে আমার খারাপ লাগল; ভাবলাম, না জানি ছেলেটার মনে কত কষ্ট। এরপর থেকে ছেলেটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে নদীর পারে ছেলেটির পাশে বসতাম। কিন্তু সে আমাকে দেখামাত্র উঠে চলে যেত। কখনো কথা হতো না। 

এভাবেই দিন যেতে থাকে। একদিন আলভীর উস্তাদ থেকে জানতে পারি, কিছু দিন যাবৎ তার বাবার কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আর বাবাই ছিল তার সব। আলভীর মা তার জন্মের পরেই মারা যান। মায়ের ইচ্ছা ছিল একমাত্র পুত্রকে আলেম বানাবেন। সে হিসেবে আলভীর বাবা তাকে মাদরাসায় ভর্তি করান। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আলভীর আপন বলতে একমাত্র বাবাই ছিল। কারো সাথে তেমন একটা মিশেও না। একা থাকতে পছন্দ করে। আর বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে খাওয়া-দাওয়া এক রকম ছেড়েই দিয়েছে। 

এসব শোনার পর আলভীর জন্য আমার খুব মায়া হয়। এভাবে দিন যেতে যেতে নতুন বছরের ভর্তির সময় চলে আসে। মায়ের শরীরটা বেশি একটা ভালো না থাকায় এ বছর আমি গ্রামেই ভর্তি হই। ঘটনাক্রমে আলভীও ছিল আমাদের জামাতে। যাইহোক, দু’দিন পর দরস শুরু হয়। আমি আলভীর পাশেই বসেছি। আলভী এখন আমার সাথে মাঝেমধ্যে কথা-বার্তা বলে। এভাবে দিন যায় রাত আসে, কিন্তু আলভীর বাবার কোন খবর পাওয়া যায় না।

আলভী শুধু কাঁদে আর আল্লাহর কাছে দোয়া করে। সারাদিন তার চেহারা মলিন হয়ে থাকে। হঠাৎ একদিন সংবাদ আসে যে, এক বাস দুর্ঘটনায় ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছে, যাদের মধ্যে আলভীর বাবাও ছিল। এ খবর পাওয়া মাত্রই আলভী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তার বাবাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে সে জানেনা। কারণ দাফন সরকারীভাবে করা হয়। আলভী এখন কিছুই করে না, অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। সারাদিন শুধু কাঁদে আর কাঁদে, যেমন বিছানায় তেমন জায়নামাজে।

আলভীর শেষ রাতের কান্না দেখে যে কেউ কাঁদতে বাধ্য হবে। এভাবেই দিন যেতে থাকে। চলে আসে ঈদ। কিন্তু আলভীর ঈদ বলতে তো কিছু নেই। সে থেকে যায় মাদরাসায়। অনেকবার বাসায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। এভাবেই মাদরাসার ছুটি শেষ হয়ে দরস শুরু হয়ে যায়। কিছুদিন পর সে জানতে পারে, তার এক প্রতিবেশী চাচা জানে যে, তার বাবাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে। ছুটে যায় সেই চাচার বাড়ীতে কিন্তু চাচা আর সেখানে থাকে না বিধায় হতাশ হয়ে ফিরে আসে। হঠাৎ একদিন আলভী কোথায় যেন চলে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় নি। কি আর করার? এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে সবাই ভুলে যাই আলভীকে। কেটে যায় সে বছর। নতুন বছরের ভর্তির সময় চলে আসে। মা এখন অনেকটা সুস্থ হওয়ায় আমি ঢাকায় পড়াশোনা করার ইচ্ছা মাকে জানালে, মা খুশি মনে অনুমতি দিয়ে দেন। ঢাকায় আসার পর চাচার বাসায় গিয়ে মাদরাসার খোঁজ খবর নিই। তারপর ভর্তি হই আজিমপুরের ‘ফয়জুল উলূম’ মাদরাসায়, ভর্তি হয়ে চলে আসি বাসায়। তিন দিন পর দরস শুরু। সে হিসেবে একদিন আগেই মাদরাসায় চলে আসি। মাদরাসায় পুরাতন সাথী ছিল বিধায় পরের দিন তার সাথে হাঁটতে বের হই ঢাকার বিখ্যাত আজিমপুর গোরস্থানে। 

হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি শেষ প্রান্তে, হঠাৎ কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে থেমে যাই। আওয়াজটা কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। কিছুটা সামনে এগোতেই দেখি এক ছেলে কাঁদছে আর বলছে, আচ্ছা! তুমি কি আর কখনো আমার কাছে ফিরে আসবে না বাবা? আমি কি তোমার কাছে চলে আসব? ছেলেটির আবেগমাখা কথাগুলো শুনে সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। হঠাৎ আমার আলভীর কথা মনে হলো। আচ্ছা, এটা আলভী নয়তো? ধূর! এখানে আলভী আসবে কোত্থেকে। এভাবে সাতপাঁচ ভেবে সেখান থেকে চলে আসি। মাদরাসায় গিয়ে সারাদিন ছেলেটাকে নিয়ে ভাবতে থাকি। 

পরের দিন আবার কবরস্থানে যাই। এবার আমি একাই গেলাম। আজকেও দেখি ওই ছেলেটা একই কবরের পাশে বসে কাঁদছে আর কুরআন তেলাওয়াত করছে। ছেলেটিকে আজ পুরো আলভীর মত মনে হচ্ছে। হঠাৎ মুখ ফসকে ছেলেটিকে ‘আলভী’ বলে ডাক দিয়ে ফেলি। ঘুরে তাকাতেই দেখি সে ই আলভী! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। চোখ মুছে আবারও তাকাই দেখি সে আলভীই। আমি বাকরূদ্ধ হয়ে যাই আলভীকে দেখে। তাকিয়ে থাকি দীর্ঘক্ষণ। কুশল বিনিময়ের পর জানতে পারি এটা তার বাবার কবর। 

তারপর দুজন মিলে কবর জিয়ারত করে কবরস্থানের বাহিরে আসি। পরে গ্রাম থেকে চলে আসার কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলে, এখানে তার প্রতিবেশী চাচার খবর পেয়ে ছুটে এসেছে, এখন সে চাচার সাথেই থাকে, আর পাশের এক মাদরাসায় পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা আলভীর বাবার কবর সহ সকল বাবার কবর রহমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিন এবং সকলের অন্তরে বাবার ভালোবাসা অটুট রাখুন। আমিন। 

মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

নবীনতর পূর্বতন