৭ই অক্টোবর; শনিবার ভোর ছ’টা, হামাসের চকিত মিসাইল আক্রমণে আলোকিত হয়ে উঠে ইসরায়েলের আকাশ।
হতভম্ব হয়ে পড়ে তাদের গর্বের ‘আইরন ডোম সিস্টেম’। ঘটনার আকস্মিকতায় শুধু ইসরায়েল না, হকচকিয়ে উঠে সুদূরে অবস্থানরত হোয়াইট হাউসের মার্কিনীরা। চিন্তার ভাঁজ পরে বিশ্ব এলিট শ্রেণীর কপালে। বিশ্ব মিডিয়ায় নতুন মাত্রা লাভ করে ইসরায়েল—ফিলিস্তিন সংঘাত। কিন্তু এর মূলে ইন্ধনদানকারী ছিল কারা? আমরা খুঁজব ইতিহাস!
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—র ইতিহাস জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে, ‘সিয়েনবাদ বা জায়োনিজম সম্পর্কে। জায়ন হলো জেরুজালেমের নিকটবর্তী একটি পাহাড়ের নাম। আর জায়োনাবাদ হলো একটি জাতীয়তাবাদ ও ভাবাদর্শের আন্দোলন। যার মূল লক্ষ্যই হলো ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ইহুদীদের জাতীবিদ্বেষী রাষ্ট্র গঠন করা এবং তা টিকিয়ে রাখা। আধুনিক জায়োনাবাদের সূচনা হয় আঠার শতকের শুরুর দিকে। যাকে জায়োনিরা বলে ‘জুইশ এনলাইটমেন্ট মুভমেন্ট’।
একদল লেখক, কবি ও রাবাই হিব্রুভাষা পুনজ্জীবিত করেন। গতানুগতিক ধর্মশিক্ষার সীমা প্রশস্ত করে একে বিশ্বজনীন করে গড়ে তোলেন। তাদের মাঝে কিছু লোক ছিলেন; যাদেরকে ‘হার্বিঞ্জার অব জায়োনিজম’ নামে ডাকা হয়।
তারা অন্যদের চেয়ে অধিকতর জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তাদের লেখাজোখায় হিব্রুকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে আবদ্ধ করা হয়। আধুনিক সিয়েনাবাদ বা জায়োনাবাদ সূচনার ইতিহাস পরিপূর্ণতা লাভ করে ‘Theodor herzl’ (থিওডোর হের্জল, তিনি বিশ^ ইহুদি সংস্থা গঠন করেন। তাকে ইসরায়েল-র জনক বিবেচনা করা হয়।) এর কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। তিনি একটি বই লেখেন। যেখানে এ আশা করেন যে, বিশ শতকের মধ্যে একটি সতন্ত্র রাষ্ট্র হবে। যেটা হয়তো ফিলিস্তিন অথবা আর্জেন্টিনা। বইটির নাম ‘ডের জুডেনস্টাটে’ (১৮৯৬)। হের্জল আমৃত্যু এই জায়োনাবাদ নিয়ে কাজ করেছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে। কিন্তু খোদ ইহুদীদের থেকেই তিনি আকুন্ঠ সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। যারা ধার্মিক ইহুদী অর্থাৎ ‘হারেদি’ তারা মনে করেন ইহুদীদের জন্য সতন্ত্র রাষ্ট্র শুধু মাসিহই প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। অন্য কেউ যদি সেটা করে তাহলে ঈশ্বরের কাজ নিজের হাতে নেয়ার মাধ্যমে পাপ কাজ করলো।
তৎকালিন সময়ে ফিলিস্তিন ছিল উসমানি খিলাফতের অধীনে। হের্জল সুলতান আব্দুল হামিদের কাছে দূত মারফতে এই আবেদন পেশ করেন যে, ‘মহামান্য সুলতান যদি ফিলিস্তিনে ভূমি ক্রয়ে সীমিত পর্যায়ে হলেও ইহুদীদের জন্য অনুমতি প্রদান করেন, তাহলে আমরা সুলতানের সকল বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে দেবো এবং....’। উসমানি সালতানাত তখন গ্রীসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে ভয়াবহ সংকটে নিপাতিত। দূতের উদ্দেশ্যে সুলতান বলেন, ‘আমি তো ফিলিস্তিনের এক বিঘত ভূমিও তোমাদের দেবো না। কারণ এর মালিক আমি নই, আমার জনগন। আমার পূর্ববর্তীগণ এই ভূমিকে সিঞ্চিত করছেন তাদের রক্ত দ্বারা। তোমরা ধৈর্য ধরো, আমার মৃত্যুর পর তোমরা মুফতে পেয়ে যাবে পুরো ফিলিস্তিন’। সুলতানের উত্তর পাওয়ার পর হের্জল বুঝে যায়, সুলতানের উপস্থিতিতে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের বাসভূমির স্বপ্ন কখনো সম্ভব হবে না।
১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ড এর ‘বাজেল’ শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে জায়োনাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত হয় যে, যে কোনো উপায়ে সুলতানকে অপসারণ করতে হবে এবং উসমানি খেলাফতের বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। লাগাতার চক্রান্তের পরিণতিতে ১৯০৯ এর জুলাই মাসের শুরুর দিকে উসমানি সালতনাতের মুফতী জিয়াউদ্দিন এফেন্দি ফতোয়া জারি করেন, ‘সুলতান আব্দুল হামিদের খেলাফতের মসনদে থাকার বৈধতা নেই। সুতরাং তাকে অপসারণ করা হলো’। সুলতানের কাছে অপসারনের ফরমান যারা নিয়ে যায় তাদের মধ্যে ছিল ইহুদীবাদী ‘ইমানুয়েল কারাসো’। সুলতান তার রোমনামচায় লেখেন, ‘আমার অপসারনের কারণ আর কিছুনা; আমি চেয়েছি যেকোনো মূল্যে ইহুদীদের ফিলিস্তিন ভূমি থেকে দূরে রাখতে। আর ইহুদীরা চেয়েছে পবিত্র ভূমিতে তাদের বাসভূমি প্রতিষ্ঠা করতে’।
বলা বাহুল্য যে, ১৯০২ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদী ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই ভাগ আর ভূমি ছিল এক ভাগেরও কম। ১৯০৪ সালে হের্জল মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় ইউরোপে তীব্র ইহুদীবিদ্বেষ গড়ে উঠে। যাকে বলে, ‘অ্যান্টি-সেটিসিজম’। যার ফলে ইউরোপে দীর্ঘসময় ধরে ইহুদীদের বিরুব্দে নানা দমন—পীড়ন দাঙ্গা ও হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এসব দাঙ্গাকে বলা হয় ‘পোগ্রোম’। ইউরোপের এই বৈরী পরিস্থিতিতে ইহুদীদের মাঝে গড়ে উঠে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ কারণে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে গিয়ে ভূমি ক্রয় করে বসবাস শুরু করে। যদ্দরুন ১৯৩০ সালে ফিলিস্তিনের ইহুদী সংখ্যা দাঁড়ায় তার জনসংখ্যার ত্রিশভাগ।
১৯১৭ সালে ব্রিটেনের বিদেশ সচিব ‘আর্থার বেলফোর’ ব্রিটিশ ইহুদী নেতা ‘ব্যারন রথচাইল্ড’-র কাছে একটি প্রস্তাব রাখে যা ‘Balfour declaration by British Government’ নামে পরিচিত। তাতে বলা হয়, যদি ইহুদীরা ব্রিটেনকে উসমানি সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করে তাহলে উসমানিদের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হলে, ব্রিটিশ ও আয়ারল্যান্ডের জায়োনিস্টদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ইহুদীরা এই কুটনীতিকে ঘোষণা মনে করে বসে এবং তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে ফিলিস্তিন ছিনিয়ে নেওয়ার পর ব্রিটেন সেখানে উপনিবেশ চালু করে। তারা ফিলিস্তিনীদের বলে, আমরা তোমাদের রাষ্ট্র শাসন করার উপযুক্ত করে চলে যাব। তারা সেখানে মুসলমান, ইহুদী, খ্রিস্টান সবার জন্য ভিন্ন—ভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে। যার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মাঝে ধর্মীয় ভেদাভেদ তৈরি হতে শুরু করে।
ইহুদীরা নিজেদের একটি স্বতন্ত্র এবং শ্রেষ্ঠ জাতী ভাবতে শুরু করে। যার ফলে তারা মুসলমানদের উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং নানা বৈষম্যমূলক আচরণ করা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নেতা ‘এডলফ হিটলারের’ নেতৃত্বে প্রায় ৬০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়। যার অধিকাংশই ছিল ইহুদী, তাছাড়া ‘কন্সেট্রেসন ক্যাম্প’ নামে তার একটি ‘টর্চার মার্ট’ ছিল যেখানে মানুষদের নিয়ে ‘গ্যাস চেম্বার’ এ ঢুকিয়ে হত্যা করা হত। ইতিহাসে এই অপতৎপরতা ‘হলোকস্ট’ নামে পরিচিত। যার ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের অপতৎপরতা দিন দিন শোচনীয় হয়ে উঠতে থাকে। যা বিশ্ব মোড়লরা তাদের স্বার্থ চরিতার্থের মোক্ষম সুযাগ হিসেবে লুফে নেয়। ১৯৪৫ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘রাষ্ট্রসংঘে’-র কাছে ব্রিটিশরা এই সমস্যা সমাধানের ভার ন্যাস্ত করে। রাষ্ট্রসংঘ ফিলিস্তিনকে তিন ভাগে ভাগ করে দেয়। মূল ভূখণ্ডের ছাপ্পান্ন শতাংশ দিয়ে দেয় ইহুদীদের এবং তেতাল্লিশ শতাংশ দেয় মুসলমানদের আর জেরুজালেমকে একটি আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে প্রায় সাত লক্ষ ফিলিস্তিনি নিজ দেশেই হয়ে পড়ে ‘রিফুজি’, ভূমিহীন। যদ্দরুন আরব এবং ইসরায়েলের মাঝে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এক লক্ষ ইহুদী ষাটহাজার মুসলমানের এ যুদ্ধে আরববিশ্ব শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। বলা বাহল্য যে, এখানে পুরো আরব বিশ্ব সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করেনি। শুধু জর্ডান, সিরিয়া, মিশর এবং ইরান ছিল এই যুদ্ধে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে; বিশ্বের যেখানেই কোনো ইহুদী থাকুক না কেন, তাকে দেয়া হবে ইসরায়েলের নাগরিকত্ব। ১৯৬৪ সালে ইয়েসির আরাফাতের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা হয় স্বাধীনতাকামী ইসলামি প্রতিরোধ সংগঠন; Palestine liberation org.।
এরপর ১৯৬৭ -র ‘সিক্রডে ওয়ার’, ১৯৭৩ —র ‘অক্টোবর যুদ্ধ’। সে যুদ্ধে অপর প্রান্ত থেকে হামলা চালায় সিরিয়া। তাদের কাছ থেকে ইসরায়েল ছিনিয়ে নিয়েছিল গোলান মালভূমি। অক্টোবর যুদ্ধে তা পুনরুদ্ধার করতে পারলেও ইসরাইল ফের দখলে নিয়ে নেয়। মিশর তাদের ‘সিনাই’ পর্বত ফিরে পেতে ব্যর্থ হয়। আরব বিশ্ব তখন শুরু করে তেলযুদ্ধ। ইসরায়েলকে সমর্থন করায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয়। হুহু করে বাড়তে থাকে জ্বালানীর দাম।
দৃশ্যপটে তখন হাজির হন ‘হেনরি কিসিঞ্জার’। তার কূটনৈতিক সফরের মাধ্যমে সমঝোতায় আসে তিনপক্ষ। কিসিঞ্জার মিসরকে রাজি করান, তার হারানো ভূমি ইসরায়েলের সাথে কথা বলে ফিরিয়ে দেওয়ার। মিসর তখন থেকে ইসরায়েল বিষয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে চুক্তিবদ্ধ হয়। সিরিয়া যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেও নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখে। কিন্তু কিসিঞ্জারের এই কূটনীতির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সঙ্গে শত্রুতা কমতে শুরু করে আরব বিশ্বের।
১৯৮৭ সালে ইসমাইল হানিয়ার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সশস্ত্র ইসলামি প্রতিরোধ গোষ্ঠি ‘হামাস’। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইয়াসির আরাফাতের সাথে সমঝোতা করে যা ‘Oslo Accords’ নামে পরিচিত।
এরপরেই ১৯৯৩ —র ১৬ সেপ্টেম্বর হামাস ইসরায়েলের ওপর প্রথম ‘সুইসাইড মিসাইল’র মাধ্যমে আক্রমন করে। ফিলিস্তিন সরকার এবং পি.এল.ও —র প্রধান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অনুগত ফাতহ বাহিনীর বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ২০০৭ সালের পর থেকে হামাস গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করে। গাজা প্রায় ১৪১ বর্গমাইলের এলাকা, যেখানে প্রায় দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের বসবাস। হামাসকে মিসরের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’র একটি অংশ হিসেবে ভাবা হয়। তারা ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। হামাস ফিলিস্তিনের নেতৃত্বভার নিজেদের হাতে আনার পর ইসরায়েল ও মিসর একযোগে গাজা অববোধ করে রাখে। গাজা দিয়ে কারও ফিলিস্তিনে আসা—যাওয়া ছিল বন্ধ। এমনকি জরুরি খাদ্য, ঔষধ সামগ্রীও ভিতরে আসতে পারে না। মিসর আর ইসরায়েলের অভিযোগ, গাজার সীমান্ত বন্ধ না রাখলে সন্ত্রাসীরা তাদের দেশে ঢুকে হামলা চালাবে।
এভাবেই বছরের পর বছর চলে আসছে ইসরায়েল—ফিলিস্তিন সংঘাত। আর নির্বিচারে মারা পড়ছে নিরীহ মুসলমান। হামাসের নেতা মুহাম্মদ দেইফ জানিয়েছেন, ‘আমাদের মিশন “আল-আকসা ফ্লাড” শুরু হয়েছে।’
ইনশাআল্লাহ অচিরেই ফিলিস্তিন তার হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করে ইহুদীবাদকে চিরতরে মিটিয়ে দিবে এ পৃথিবী থেকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন