ফুল, ফুল, ফুল। ফুল নিবেন ভাই। ফুল মাত্র বিশ টাকা পিস। একটা ফুল নেন না ভাই।
-অ্যাই যা তো এখান থেকে।
ধমক দিয়ে মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিল ড্রাইভার করিম মিয়া, প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে জ্যামে আটকে আছে সে। এমনিতেই কিছুদিন যাবৎ গরমটা একটুবেশি। রোদের তাপ এতটাই প্রখর যে, বারবার জিহ্বা শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ওপর আবার ঢাকা শহরের এই যানজট। সবকিছু মিলিয়ে করিম মিয়ার মেজাজটা খিটখিটে হয়ে আছে। তাই মেয়েটি সামনে চলে আসায় রাগের ঝড়টা তার উপর দিয়েই বয়ে গেছে। ছাতিফাটা এ রোদে গাড়ি নিয়ে বেরোতে করিম মিয়ার অনীহার শেষ নেই। তবুও বের হতে হয় পেটের দায়ে। সে চাকুরী করে প্রফেসর মুহসিন সাহেবের অধীনে। মুহসিন সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দ্বীনদার প্রফেসর। ভালো ব্যবহার আর পরিশ্রমী হওয়ার কারণে সহকর্মীদের পাশাপাশি ছাত্রদের নিকটও তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। সাধারণত অফিস থেকে বাসা আর বাসা থেকে অফিস যাতায়াত করলেও, প্রয়োজনে বিভিন্ন দিকে যেতে হয় প্রফেসর সাহেবের। তখন ড্রাইভার হিসেবে করিম মিয়াকেও সঙ্গে যেতে হয়।
আজ বেরিয়েছে রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সামনে দিন কয়েক পরেই ঈদুল আযহা। তাই প্রফেসর সাহেব স্ব-পরিবারে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন ঈদুল আযহা উদযাপনের জন্য। ঈদকে কেন্দ্র করে সর্বত্রই চলছে নানা আয়োজন।
রেডিও টেলিভিশন কিংবা পত্র-পত্রিকায় ঈদকে নিয়ে দেখা যাচ্ছে নানান কর্মসূচি। রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে ‘ঈদ মুবারক’ লেখা বিভিন্ন ধরনের পোস্টার-ব্যানার। অনেক জায়গায় আবার একটুভিন্নভাবে লেখা ‘হাম্বা মুবারক’। গ্রাম কিংবা শহর সবজায়গায় বসেছে গরু-ছাগলের হাঁট। কাউকে দেখা যাচ্ছে কোরবানির পশু কিনে বাড়ি ফিরতে। কেউ আবার কোরবানির পশু কিনতে ছুটছে হাঁট অভিমুখে। কেউ গরু কিংবা মহিষ, কেউ ছাগল বা দুম্বা, আর কেউ উট কোরবানি করে। আর কারো বা সাধ্যের বাইরে, কোরবানি দেওয়া। ঈদুল আযহার আগে সপ্তাহব্যাপী প্রায় সব হাঁটেই থাকে প্রচন্ড ভীড়। অনেকে আবার হাঁটে যাওয়া ঝামেলা এড়াতে, নিজ গ্রামেই পরিচিত কারো কাছ থেকে কোরবানির পশু কিনে। প্রফেসর সাহেবও কিনেছেন নিজ গ্রামেই।
আরেক শ্রেণির মানুষ ঈদের শপিং করতে যাচ্ছে ব্যাংকক, দুবাই, পুত্রজায়া কিংবা আধুনিক বিশ্বের অন্য কোনো উন্নত শহরে। কেউ যাচ্ছে বসুন্ধরা বা যমুনা ফিউচার পার্কে। কেউবা ফুটপাতে বা সাধারণ মার্কেটগুলোতে। আর কারো কেনাকাটার সামর্থ্যই নেই। সাধারণত শপিংয়ে এধরনের দৃশ্য দেখা যায় ঈদুল ফিতরে। ঈদুল আযহায় শপিংয়ের তেমন একটা প্রয়োজন থাকে না। টুকটাক কিছু কেনাকাটা ছাড়া প্রায় সকলেই ঈদুল ফিতরে ঈদুল আযহার শপিংয়ের ঝামেলাটা সেরে ফেলেন। হ্যাঁ, দু’একজন হয়তো এ সময়টাতে শপিং করে। যেমন দিন কয়েক আগে প্রফেসর সাহেব উত্তরা গিয়েছিলেন পরিবারের সবার জন্য ঈদের শপিং করতে। আজ যাচ্ছেন গ্রামে। গাড়ির মধ্যে এসি চলা সত্ত্বেও বেশ সময় যাবৎ হাঁসফাঁস করছে করিম মিয়া। পিছনে বসা ওয়ালিদ বয়সে ছোট হলেও বিষয়টি তার নজর এড়ায়নি। সে বলল,
-চাচা এই গরমের জ্যামে আটকে পড়ায় আপনার বোধহয় বিরক্তি লাগছে। অস্থির হবেন না, ইনশাআল্লাহ, জ্যাম এখনই ছুটে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যিই জ্যাম ছুটে গেল। ছোটরা নাকি নিষ্পাপ হয়। করিম মিয়া ভাবল, নিষ্পাপ বলেই হয়ত তার কথা এত দ্রুত সত্যে পরিণত হল। ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে, এদিকটায় রাস্তা বেশ ফাঁকা। এসি বন্ধ করে গাড়ির জানালা খুলে দেওয়ার পর একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসলেন প্রফেসর সাহেব। যমুনা সেতুতে ওঠার মাইল খানেক আগে, ছিমছাম একটা এলাকা দিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। রাস্তার দু’ধারে জানা অজানা নানান জাতের অসংখ্য গাছের সারি। চারদিক বেশ নীরব। প্রাকৃতিক বাতাসটা বোধহয় বেশ উপভোগ্য এখানে। একটুপরেই গাড়িটা যমুনা সেতুতে ওঠবে।
ঠিক এমন সময় সেতুথেকে নেমে আসা দ্রুতগামী একটা মাইক্রো ব্রেকফেল করে ওয়ালিদদের গাড়ির দিকে তেড়ে আসে। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে দূর্ঘটনা। মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে উভয় গাড়িই বেশ ক্ষতিগ্রপ্ত হয় এবং চালকসহ সামনে থাকা দু’জনের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে।
এ চারজনের মধ্যে প্রফেসর মুহসিনও সাহেবের স্ত্রী ও তার দুই ছেলে নিহত না হলেও গুরুতর আহত হয়। ঘটনাস্থলের অদূরে থাকা টোলবক্সের লোকেরা দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করলে, জরুরী ভিত্তিতে এম্বুলেন্স এসে লাশগুলো সহ আহতদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের বাড়িতে মুহসিন সাহেবের বৃদ্ধা মায়ের কাছে হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। বৃদ্ধা প্রায় দৌঁড়ে বাড়ির উঠান থেকে ঘরে আসেন এ আশায়, হয়ত ছেলের ফোন। ফোনটি সত্যিই ছেলের ছিল, তবে ফোন ধরার পর পরই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে। ‘এই ফোন ব্যবহারকারী এক্সিডেন্ট করেছেন। গাড়িতে আরো কয়েকজন ছিল, সবার অবস্থা গুরুতর। আপনি তাদের আত্মীয় বা পরিচিত কেউ হলে দ্রুত এই ঠিকানায় চলে আসুন’। খবরটা শোনা মাত্রই বৃদ্ধার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মুহূর্তেই তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পূর্বেও তিনি বেশ আনন্দিত ও উৎফুল্লছিলেন। কারণ, আজ বেশ ক’মাস পর তার ছেলে বাড়ি ফিরছে।
বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা সত্ত্বেও নিজ হাতে রকমারি পিঠা বানানো, ছেলের পছন্দনীয় খাবাবের আইটেমগুলো রান্না করা, দুই নাতির জন্য এটা-ওটা তৈরী করা সহ আরো কত কী করেছেন। সেই ছেলেটিই এখন রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের বেডে। বেঁচে আছে না মারা গেছে বৃদ্ধা তা জানেন না। ছেলের বউ আর নাতিরাই বা কেমন আছে, তা-ও অজানা তার। অথচ বাসা থেকে বের হবার পর বেশ কয়েকবার ছেলের সাথে কথা বলেছেন তিনি। এমনকি হাসপাতাল থেকে ফোন আসার কিছু আগেও কথা বলেছেন। ঘন্টা দুয়েক পরে হাসপাতালে পৌঁছার পর যখন ভিতরে প্রবেশ করছিলেন, তখন হাসপাতালের করিডোরে পা রাখতেই ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। হয়তো ছেলে আমার আর বেঁচে নেই। কিছুক্ষণ পরে যখন তাকে তার ছেলের লাশের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। লাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অজ্ঞান হয়ে যান।
ঈদের দিন কিংবা দিন কয়েক আগে পরে সন্তানের জন্য অপেক্ষমান অনেক মায়ের কাছেই হাসপাতাল থেকে এমন ফোন আসে। সারাদিনের অপেক্ষা শেষে রাত কিংবা পরদিন জানা যায় অমুক জায়গায় দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছে কিংবা আহত হয়ে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে পড়ে আছে কোনো এক হাসপাতালের বেডে। ছোট ভাই বোন সারাদিন ভাইয়ার অপেক্ষায় থেকে ঘুমিয়ে পড়ে। আর সকালে যখন ভাইয়ার সম্পর্কে এমন কিছুশোনে, তখন ছোট আর অবুঝ হওয়া সত্ত্বেও তারা পেরেশান হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকার পরও সমবয়সীদের সাথে মিলেমিশে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। সানন্দে ঈদ উদযাপন করা সবার ভাগ্যে জুটে না।
আমাদের দেশে অহরহ ঘটছে এমন দূর্ঘটনা। পত্রিকার পাতায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই পাওয়া যায় এমন সব দূর্ঘটনার বিবরণ। তাই আমাদের উচিৎ কিছু সদকা করার পর সফরে বের হওয়া। সফরের বিভিন্ন মাসনুন দোয়া পড়া সহ যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করার পাশাপাশি পূর্ণ সচেতন থাকা।
আল্লাহ তা‘আলা রক্ষাকর্তা!!!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন