অবশেষে উপলব্ধি
১.
মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় আদিলের। বড্ড পিপাসা পেয়েছে। পাশে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক শ্বাসে সব পানি গলা দিয়ে চালান করে দিলো। একটা ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছে সে। ঘেমে পুরো শরীর ভিজে জবজবা হয়ে গেছে। লজ্জা আর অনুশোচনায় পুড়ে ছারখার হয়ে যায় তার হৃদয়টা। একটা অপরাধবোধ সব সবসময় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। জীবনের সমীকরণটা অনেকে মিলাতে পারলেও তার বেলায় কেনো যেনো মিলেনা, কোথাও যেনো একটা ফাঁকা রয়ে গেছে, আর সেই ফাঁকা থেকেই তার জীবনে নেমে আসে হতাশা, অপরাধবোধ ও জীবনের প্রতি অনিহা। যেনো সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে পাখির মতো ডানা মেলে আকাশে উড়াল দিতে পারলে ভালো হতো। জীবনাকাশে দূর দিগন্ত পর্যন্ত মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। সে ভাবে একদিন তার জীবনাকাশে দিগন্ত কালো করে মেঘ জমবে, সেই মেঘ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়বে। আর সেই বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যাবে অতীতের সব পাপ, অনুশোচনা আর হতাশা। কিন্তু মানুষ যা চায় তা কি সব সময় হয়? জীবনের এত সব দায়বদ্ধতা কি কখনো এড়ানো যায়। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে দিগন্ত আলো করে সোনালী সূর্যটা পৃথিবীবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে টেরই পায়নি সে। চোখ খুলে বিছানায় শুয়ে থাকে। বাতাসে জানালার পর্দাগুলো হালকা নড়ছে। একটি শীতল হাওয়া তনুমন ছুঁয়ে পুরো ঘরটাকে শীতল করে দিয়ে গেছে। শীতকাল প্রায় এসে গেছে, হালকা শীত শীত লাগছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠল আদিল। বারান্দায় যেতেই সকালের মিষ্টি রোদ মৃদু আলিঙ্গন করলো তাকে। উঠোনের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় যেন পাখিদের আসর জমেছে। তাদের কিচিরমিচির আওয়াজে পুরো বাড়ি মুখরিত হয়ে আছে। পাখিদের আনন্দ দেখে কিছুক্ষণের জন্য অতীতে হারিয়ে যায় সে।
২.
এমনই একটা হাসি খুশি পরিবার ছিল তার। বাবা—মা আর সে। তিনজনের ছোট্ট একটি পরিবার। কোন অভাব ছিল না এই পরিবারের। আনন্দ আর হাসি খুশিতেই কেটে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলো। কিন্তু এই সুখ আর বেশি দিন স্থায়ী হলো না। একদিন সকালে আদিলের বাবা ব্যবসার কাজে শহরে যায়। স্ত্রীকে বলে যায় রাতেই ফিরে আসবে। কিন্তু সেই ফেরা আর হলো না। একটি সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যায় আদিলের বাবা। বিকেলের দিকে লাশ বাড়িতে আনা হয়। আদিল তখন ছোট। সে দেখে কাকে যেন সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে একটি খাটের উপরে রাখা হয়েছে, তারপর সবাই নামাজ পড়ছে। নামাজ শেষে লোকজন খাটটিকে কাঁধে তুলে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখে মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁধছে। এসবের কিছুই সে বুঝে উঠতে পারে না। এরই মাঝে কেটে যায় অনেকগুলো বছর।
৩.
আদিল এখন ২০ বছরের যুবক। ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। স্বভাবে বেপরোয়া ভাব। কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। তার কাজে বাঁধা দেওয়ার মত হিম্মত কারো নেই। এমনকি তার এসব আচরণ থেকে তার মা-ও বাদ যায়নি। একদিন পার্টিতে যেতে নিষেধ করেছিল রাত অনেক হয়েছে বলে, কিন্তু এতে সে রেগে গিয়ে তার মাকে এতই জোরে ধাক্কা মারলো যে, তার মা গিয়ে সোজা মেঝেতে পড়ে। এবং পায়ে প্রচুর ব্যথা পায়। রাগে গজগজ করতে করতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় আদিল। মনিরা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন আর ভাবেন এই দিন দেখার জন্যই কি তিনি তাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছিলেন? বাবা নেই বলেই হয়তো আজ সে এত বেশি বেড়ে গেছে। কিন্তু তিনি তো কখনো বাবার অভাব বুঝতেদেননি। এরপরও কেন এমন বখে গেল ছেলেটা? কাল ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। বন্ধুরা ধরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মনিরা বেগমকে ফোনে জানানো হলে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাড়াতাড়ি হাসপাতালের দিকে রওনা হন।
৪.
মনিরা বেগম ডাক্তারের সামনে বসে আছেন। ডাক্তারের হাব—ভাব থেকে বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে তার ছেলের। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার মুখটা গম্ভীর করে বলল, দেখুন অবস্থা খুবই খারাপ, ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ফোর্থ স্টেজে আছে। বেশি হলে বড়জোর চার মাস....। মনিরা বেগমের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার আদরের ছেলে আর মাত্র চার মাস বাঁচবে! কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অনেক কষ্টে ডাক্তারকে বললেন বাঁচানোর কোনো উপায় আছে কিনা? কপালের ভাঁজ খানিকটা গভীর করে ডাক্তার বললেন, একটা উপায় সম্ভবত আছে। যদি কোনো সুস্থ মানুষের ফুসফুস এনে বসানো যায় তাহলে বাঁচানো যেতে পারে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ডাক্তারকে বললেন .... ।
তিনদিন পর আদিলের হার্টের অপারেশন সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে তার মাকে একটি বারও কোথাও দেখেনি। মা মনে হয় তার ওপর রাগ করেছে। তাই হাসপাতালেও তাকে দেখতে আসেনি। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, বাসায় ফিরেই মায়ের পা দুটো জরিয়ে ধরে মাফ চাইবে। আর কখনো এমন করবেনা। সব সময় মায়ের কথা শুনবে। মায়ের সেবা করবে। সন্ধ্যায় ডাক্তার এসে সবকিছু পরিক্ষা করে বলল, আগামীকালই আপনি বাসায় যেতে পারবেন। আর যাওয়ার সময় আদিলের হাতে একটি খাম দিয়ে গেলো আর বললো বাসায় গিয়ে পড়বেন।
৫.
প্রিয় আদিল,
আশা করি ভালো আছিস। তুই ভালো থাক এটাই আমি সারাজীবন চেয়েছি। বাবা আমার, তোর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তোকে কোলে-পিঠে করে বড় করেছি। কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেইনি। যখন যা চেয়েছিস সেটাই এনে দিয়েছি। তোর বেপরোয়া আচরণ গুলো যদিও আমাকে কষ্ট দিতো, কিন্তু পরক্ষনেই তোর মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যেতাম।
ডাক্তার বললো তোর ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে। আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পরলো। ডাক্তার বললো একটা সুস্থ ফুসফুস হলে বাঁচানো যেতে পারে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম আমি দিবো, আমারটা নিয়ে নিন। দুনিয়াতে তুই-ই আমার সব ছিলি। তোর কোনো কষ্ট হোক এটা আমার সহ্য হত না। সব মায়েরাই তো চায় জীবনের বিনিময়ে হলেও তার ছেলে যেনো পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে বেড়ে উঠে। মন খারাপ করিস না, এছাড়া আমার কাছে অন্য কোনো পথও ছিল না। মা নেই বলে মায়ের উপর অভিমান করে থাকিস না। জীবনটাকে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিস, কেমন? তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই, ভালো থাকিস।
...ইতি তোর ‘মা’।
কোন মন্তব্য নেই