ভুলিয়ে দাও এই হাহাকার
১.
একটি নারিকেল গাছ। পাতাগুলো সবুজাভ। কাঁচা-পাকা কিছু নারিকেল। বাতাসে দুলে ওঠে হঠাৎ। রাত্রির সব নীরবতা ছাপিয়ে একটি শব্দ হলো ‘ধুপ’! আমার বই পড়ায় ছেদ ঘটে। রান্নাঘর থেকে আম্মুর অস্পষ্ট আওয়াজ- “নারিকেলটা নিয়ে আয় তো”! অলস শরীরে পা ছড়িয়ে বসে আছি বিছানায়। কারেন্ট চলে গেছে সেই সন্ধ্যায়। ছোট্ট টর্চটা নিয়ে কোনোক্রমে মুসা আল হাফিজের ‘মহাকালের বাঁশি’ বইটির শেষ প্রান্তে চলে এসেছিলাম। শেষ করতে পারলাম না। গামছাটা গায়ে জড়িয়ে কোনোক্রমে উঠলাম বিছানা থেকে। টর্চহাতে দরজা খোলামাত্রই শীতল বায়ুতে বাঁপাশ থেকে গামছাটা পড়ে গেল। গামছাটা ঠিক করতে করতে পা বাড়ালাম বাইরে। জুতা পরার প্রয়োজন বোধ হয়নি। হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে চোখ বুলালাম চারপাশটায়।
বসন্তি হাওয়ায় ভুলে গেছিলাম এখন বর্ষাকাল, তিন দিন আগে বৃষ্টি পড়েছিল। এরপর হয়নি। উঠোনের স্যাঁতসেঁতে ভাবটা কেটে গেছে। কাঁদা নেই একদম। হাঁটতে বেশ লাগছে। লুঙ্গিটা শক্ত করে বেঁধে নিলাম। হুট করে টর্চটা নিভে গেল, সম্ভবত চার্জ শেষ। গাঢ় অন্ধকার। আঁচ করে পৌঁছে গেলাম নারিকেলতলায়। বিশালকায় গাছ। বয়স হয়েছে অনেক। সেই ছোটোবেলা থেকেই দেখছি। কয়েকবার ঝড়-তুফানে পাশের কিংবা কাছাকাছি অবস্থানে থাকা গাছগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সে টিকে আছে স্ব-মহিমায়, সগর্বে। গাছটার নীচে সবুজ ঘন ঘাস। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে, অনিন্দ্যসুন্দর সবুজ গালিচা যেন। আমি সেখানে বসে পড়লাম, খালি গা, শূন্য পা,বৃদ্ধ নারিকেলগাছ, বর্ষার মৃদুমন্দ বাতাস- সবমিলিয়ে পরিবেশটা সুন্দর হয়ে উঠেছে, হয়ে উঠেছে উপভোগ্য। নীরবতা বড় অদ্ভুত, নৈঃশব্দ গূড় রহস্যময়। বয়ে চলা স্মৃতি, দুঃসহ চিন্তারা কিলবিলিয়ে ওঠে নোটিশহীনভাবে। দু’চোখ বন্ধ হয়ে যায় অজানায়, অথবা চলে যায় দূর আকাশে । নারিকেলগাছ নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি আছে। যেগুলো সুখের, আনন্দের। যেগুলো কখনো ভোলা যায় না, যাবে না।
২.
তখন কৈশোরের ঊন্মেষকাল। হেফ্জখানায় পড়ি। সুদূরে নির্বাসিত আমার জীবন। তখন সবকিছুতে সুখ পেতাম নির্মল, অনাকাঙ্খিত কিছুতে দুঃখ পেতাম প্রবল। সবমিলিয়ে সময়গুলো ছিলো আনন্দমেদুর।
হেফজ জীবনে আমাদের মাদ্রাসার দুটো ভবন ছিলো। একটি আধাপাকা আর অন্যটি টিনের। পুরনো আধাপাকা ভবনটি ছিলো পশ্চিম দিকে আর দক্ষিণ দিকে ছিলো টিনের ভবনটি। মাঝখানে বিশাল মাঠ। দক্ষিণ দিকে পুকুর। পূব দিকে সারি সারি নারিকেলগাছ, আমগাছ, সুপারিগাছ। গাছগুলোর পরেই পাকা সড়ক। সড়কের পাশ ঘেঁষে রেল লাইন। শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটে চলে খানিক পর পর। হেফজ জীবনের সবচে’ সুখকর সময়টা ছিলো বিকেল, আমার জন্য। খানিকটা চুপচাপ ছিলাম। খেলাধুলা আর দূরন্তপনায় এতোটা সক্রিয় ছিলাম না। বিকেলের মূল আকর্ষনই ছিলো এই সারি সারি গাছগুলো আর ভয়ংকর রেললাইন। বিকেল হলে দৌঁড়ে নারিকেলতলায় চলে যেতাম। নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখতাম গাড়ি আর মানুষের আনাগোনা। একধরণের কাব্যিক নিমগ্নতায় ডুবে যেতাম অজান্তে। কোনোদিন কেউ থাকলে গল্প হতো এই-সেই নিয়ে। আমার সুখমেদুর বিকেলগুলো এভাবেই কেটে যেতো নারিকেলগাছের সাথে একান্তে, নীরবে।
একদিন হেফজখানার আমির হামজা সাহেব খুব মেরেছিলেন। এগারো বছর বয়েসী আমার মনে সে মার দাগ কেটেছিলো খুব। সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় তখন রাগ আর অভিমানে আমি মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে গেলাম পালাবো বলে। গাছগুলোর নিকট আসতেই দোটানায় পড়ে গেলাম। আমি পালিয়েছি- এটা আমার আম্মু জানতে পারলে মন খারাপ করবেন খুব। সব সিদ্ধান্ত পাশে ঠেলে আমি বসে গেলাম নারিকেলতলায়। খানিক বাদে চোখ লেগে গেল। এক ঘুমে পার করে দিলাম রাত। ফজরের পর চোখ মেলে দেখি, আমির হামজা সাহেব হুজুর দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। প্রভাতের কুসুমস্নাত সূর্যের আলোতে তাঁর দাঁড়িগুলোকে দেখাচ্ছিল দ্যুতিময়। মোলায়েম কন্ঠে বললেন, ‘তুই এখানে কেন..?। আমার সাথে রাগ করছোস..? আচ্ছা এখন থেকে আর মারব না তোকে। তুই ওযু করে আমার রুমে আয়।’ সেদিন হুজুর আমাকে অনেক আদর করেছিলেন। স্নেহসংকটের এই যুগে সেই মমতা আর স্নেহের কথা মনে পড়ে খুব। আহ! কৈশোরের সেই শেষ বিকেলের আশ্রয় নারিকেলগাছ।
এরপর সাতটা বসন্ত পার হয়ে যাচ্ছে - তোমাদের পবিত্র ছায়া আর পাই না। তোমাদের ছেড়ে যাওয়ার পর এখন আর নিয়মকরে নারিকেলতলায় বসা হয় না। হয়তো আমি আজ অনেক দূরে চলে এসেছি; তবু অতীতের বুকপকেটে তোমাদের স্মৃতি আজও রয়ে গেছে অমলিন...!
৩.
“কিরে, ঘরে আয়! ঘুমাবি না!”
দৈবাৎ আম্মুর ডাকে আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। “আসছি আম্মু” -বলে গামছাটা ঠিক করে নিলাম। চার্জহীন টর্চটার মরা আলোয় খুঁজে পেলাম নারিকেলটা। বেশ পেকেছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আবার ফিরলাম নারিকেলগাছটার দিকে। অন্ধকারে আবছা দেখা যাচ্ছে। পাতাগুলো বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে। কবি ‘আল মাহমুদের’ মতো আমি বিড়বিড় করে বলে উঠলাম- “যে পারো ভুলিয়ে দাও স্মৃতিদের এই বিমর্ষ হাহাকার..!”
কোন মন্তব্য নেই