একটি প্রশ্ন জীবনকে বদলে দিতে পারে
প্রতিনিয়ত সূর্য উদিত হচ্ছে। তার আলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। দিনগুলো আগের মতই আছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে চাঁদমামার সাক্ষাৎ নসিবে জুটছে। জ্যোৎস্নাময় রাতে কবি তার কবিতা লিখছে। কোনো পাঠক হয়ত তার পাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ী তার ব্যবসার হিসাবের জন্য একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হিসাবে মশগুল হয়ে পড়ছে। এভাবেই পৃথিবী চলছে তার আপন গতিতে, ব্যস্ততার শিকড় গেড়েছে মানুষের মাঝে। কেউবা হারিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত জীবন থেকে ভালোবাসার টানে প্রেমের জগতে। জীবনের এই ছোট্ট ডায়েরিতে অনেক কিছুর উত্থান ঘটে। আবার কালের পরিক্রমায় পতনও জুটে।
লোকে বলে এটাই জীবন। সুখ-দুঃখ, ব্যাথা, বেদনা ক্লান্তি, শ্রান্তি বেষ্টিত যে জিনিসটা তাকে বলে জীবন। যদি জীবনের সংজ্ঞা এরকম না হত, তবে হয়ত কোনোদিন ঘটত না যে; একসাথে চলা, একসাথে পড়া বাল্যকালের ঐ স্কুলবন্ধু আজ ফুটপাতের পাশে ছোট্ট দোকানে কর্মরত। আর অপরজন স্নাতক ডিগ্রির জন্য ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। যদি এরকম না হত তবে হয়ত কোনোদিন পরিলক্ষিত হতো না এমন বিপরীতমুখী চিত্র; পরীক্ষার্থীর একজন জীবনের যুদ্ধে আহত, অপরজন ইউনিভার্সিটির ল্যাবে বসে ভাবছে– কর্মজীবনে মানুষ কেন বেশি ডিপ্রেশনে থাকে। যদি এরকম না হত, তবে হয়ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সময়ের ব্যবধানে একই বিষয়কে কখনো পরিবর্তন করতেন না; “যদি পুরাতন প্রেম আটকা পড়ে যায় নব প্রেমজালে, তবুও মনে রেখো ভালোবাসা যা দেয় তা থেকেও বেশি কেড়ে নেয়”। দুনিয়ার এই নির্মম বাস্তবতার সাথে মল্লযুদ্ধ করে অর্জন করে নিতে হয় কিছু কালের শান্তি। বিরামহীন কষ্টের কিছু প্রাপ্তি সেই দিন তাকে ভুলিয়ে দেয় ক্লান্ত-অবিশ্রান্ত হওয়ার কথা। শুধু মনে পড়ে আজ আমি স্বার্থক। জীবনের এই রঙ্গমঞ্চের বাস্তবতা মনে হয় এমনই। অনেককিছু কষ্ট বিহীন আসে, আবার অনেককিছু কষ্ট করেও ভাগ্যে জুটে না। মানুষ দুনিয়ার এই নির্মম বাস্তবতার শিকার প্রতিনিয়ত হচ্ছে হবে। তবে একটি বিষয় তোমাকে আড়াল থেকে যেন কিছু বোঝাতে চায়। তোমাকে আরো বেশি বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে চায়। কেউ তা শুনতে পায় সৃষ্টির সূচনালগ্নে, কেউ পায় জীবনের শেষপ্রান্তে। আবার কারো কাছ থেকে হাতছানি দিয়ে বিদায় নেয়। কেউ বা তার সন্ধান পায় না। কেউ তার অনুভব করতে পারে না। বুঝতে পারে না জীবনের এই রহস্য।
তা হল একটি মাত্র শব্দ ‘কেন’। তাহল একটিমাত্র বাক্য ‘কেন এই পথ চলা’ ‘কেন জীবনের যুদ্ধের এই খেলা’ ‘কেন এই আয়োজন’ ‘কেন তার এত প্রয়োজন’?
প্রিয় পাঠক! এই একটি প্রশ্ন নিয়ে এক পথিক হেঁটেছে পথে পথে। কবির ভাষায়, “সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশিথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে”। কিছু খোঁজার অন্বেষণে, ক্লান্ত-শ্রান্ত হৃদয়ে ফিরেছে বেলা শেষে। গিয়েছে দার্শনিকের কাছে, প্রশ্ন করেছে, কেন এই পথ চলা? কেন জীবন যুদ্ধের এই খেলা? কেন লাবণ্যরেখা পার হলে জীবন থেকে জীবনান্তে পৌঁছা যায়? কেন অমোঘ পরিণতি সামনে রেখে মৃত্যুকে চেয়ে অথবা না চেয়ে জীবনের ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র মুহূর্তগুলো চলে যায়? কেন এ পরিবর্তন? কেন এই বিবর্তন? শান্ত মনে বেলা ফুরানোর আগেই ফিরেছিল আপন ঘরে। ওই দিন বুঝেছে জীবনের এই নির্মম বাস্তবতা। বলেছে, যা আজ বাস্তবতা তা পরিণত হয়েছে অবাস্তবতায়। যা অবাস্তবতা তা পরিণত হয়েছে বাস্তবতায়।
হ্যাঁ, পাঠক! ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র একটি শব্দ নিয়ে তুমিও ভাবো। প্রশ্ন করো, কেন আমি এখানে? আমিই বা কে? আমার গন্তব্য কোথায়? চোখ বন্ধ করে একটু ভাবো! অবশ্যই সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাবে। সেই হারানো অতীত। স্বজনদের প্রিয় মুখগুলো কালের যাত্রাপথে যেভাবে পৃথিবীতে একদিন এসেছিল, কান্নাকাটি করে জানিয়েছিল তার উপস্থিতির কথা। বাল্য, কৈশোর, যৌবন কোনদিন এলো আর কোনদিক দিয়ে পালিয়ে গেল! আগের ফেলে আসা দিনরাত, চৈত্র-বৈশাখের দাবদাহ, আষাঢ়-শ্রাবণের অক্লান্ত বৃষ্টিধারা, পূর্ণিমার অপরূপ চাঁদ। বাঁশবাগানে মাথার উপর দাঁড়াতে না দাঁড়াতে জোনাকিপোকা টিপ টিপ আলো জ্বালিয়ে, গৃহস্থের উঠোন বাড়ির পিছনে বিশাল পুকুর পেরিয়ে টিপ টিপ আলো জ্বেলে চলে যায় দিগন্তে। জোনাকিপোকার ন্যায় জীবনের সময়গুলো এভাবে চলে যায়। বাল্যকাল থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে, যৌবনের পর বুঝতে না বুঝতেই মাথার চুল শূভ্র হয়ে যায়। এ কয়েক ধাপ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষ পৌঁছে যায় জীবন থেকে জীবনান্তে। তখন এই স্মৃতিগুলোও বিদায় নেয় চিরতরে।
প্রিয় পাঠক! জীবনান্তে পৌঁছার আগেই আমার জানতে হবে জীবনের রহস্য। জীবনের চাওয়া। তবেই সার্থক হবে জীবনের এই ক্লান্ত ও শ্রান্ত বেলা।
কোন মন্তব্য নেই