আমাদের আদর্শ যিনি
আল্লামা তক্বী ওসমানী দামাত বারাকাতুহুম!
একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ। যার সুবাসে পৃথিবী সুভাসিত হচ্ছে। আজ তাঁর শৈশব-কৈশোর নিয়ে কিছু আলোচনা করব। বরিত এই মহান মানুষটি ৩রা অক্টোবর ১৯৪৩ সনে দেওবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হলেন জগদ্বিখ্যাত আলেম মুফতি শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। আর মাতা নাফিসা খাতুন, যিনি জগৎ ধন্য করেছেন তাঁর মত শিশুটিকে জন্ম দিয়ে।
জন্মের দ্বিতীয় দিনের একটি ঘটনা: তিনি বিছানায় শায়িত। হঠাৎ উপর থেকে একটি বিষধর সাপ বিছানায় তার পাশে পড়ল। তাঁর মা দেখা মাত্রই সাপটিকে মেরে ফেললেন। বড় হয়ে যখন তিনি এই ঘটনাটি শুনতে পেলেন, তখন বলেছিলেন, হায়! যদি সাপটিকে না মারা হত তাহলেই তো এই তক্বী কেয়ামতের দিনে হিসাবের কঠিন ভয়াবহতা থেকে বেঁচে যেত। আর আমরা বলবো, তাহলে তো বিশ্ববাসী অজান্তেই গোলাপের একটি মুকুল হারিয়ে ফেলত।
জন্মের পর থেকে পূর্ণ পাঁচ বছর তিনি দেওবন্দে কাটান। এটা শৈশবের এমন একটা সময়, যাতে একটি শিশুর অনুভূতিতে খেলাধুলা ছাড়া অন্য কিছুই জাগ্রত হয় না। এবং সেই সময়গুলোর সবকিছুই স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যায়। তবে শিশু তক্বীর বেলায় এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। শৈশবের সেই হৃদয় জুড়ানো স্মৃতিগুলো এখনও তার স্পষ্টভাবে মনে আছে।
মকবুল বান্দাদের এটাই একটি বড় আলামত যে, তাঁরা শৈশব থেকে প্রস্ফুটিত হয়ে বড় হতে থাকেন। ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় বাবা-মার মায়া-মমতা তিনি সবচেয়ে বেশি পেয়েছিলেন। তাঁর মা তাকে মমতার কোমল স্পর্শ দ্বারা সর্বদাই আগলে রাখতেন। এবং এক মুহুর্তের জন্য শিশু তক্বীকে ছাড়া স্থির থাকতে পারতেন না। তাঁর বাবা যখনই বাজারে যেতেন সঙ্গে করে সবসময় তাকে নিয়ে যেতেন। অন্যান্য শিশুদের মত কোনো কিছু চাওয়ার স্বভাব তাঁর ছিল না। তাই বাজার থেকে ফেরার পথে বাবা ইচ্ছা করেই শিশু তক্বীকে কোনো চকলেট বা সন্দেশ জাতীয় কিছু হাতে ধরিয়ে দিতেন। শিশু তক্বী তা পেয়ে খুব খুশি হতেন। এটা বাবার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
একবার তিনি শিশু তক্বীকে নিয়ে বাজারে যান এবং আলু কিনে বাড়ির পথে রওনা হন। অন্যান্য দিনের মতো আজও তাঁর কিছু পাওয়ার আশা ছিল। কিন্তু বাবা তাঁকে আজ কিছুই কিনে দিলেন না। কোনো কিছু চাওয়ার অভ্যাস যেহেতু আগে থেকেই ছিল না, তাই অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো বাবা আজ না হয় একটা আলু আমার হাতে দিন। এই কথা শোনামাত্রই বাবার আর বোঝার বাকি রইল না যে, শিশু তক্বী কি বোঝাতে চাচ্ছেন।
পরবর্তীতে এই ঘটনাটি নিয়ে তাঁর মা ও ভাই-বোনদের মাঝে খুব আলোচনা হয়েছিল। তিনি পাঁচ বছর বয়সে উপনীত হলে দেশভাগের কারণে বাবা পুরো পরিবার নিয়ে পাকিস্তান হিজরত করেন। সেখানে অবস্থান করার পর বাবা তক্বী সাহেবের জন্য একজন ঘরোয়া ওস্তাদ ঠিক করলেন।
হযরত মাওলানা নুর আহমদ সাহেব— তিনিই তাঁর শৈশবের প্রথম ওস্তাদ। তাঁর কাছে তিনি ‘কায়দায়ে বোগদাদী’ শেষ করেন। তারপর ‘আমপারা’ দিয়ে ‘কুরআনুল কারিমের’ দরস শুরু করেন। এই সুযোগে তিনি তাঁর কাছে বেহেশতী গাওহার, বেহেশতী জেওর, ও সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া কিতাবগুলো পড়েন। পরে যখন দারুল উলুমে ভর্তি হন হয় তখন তাঁর শিক্ষার নতুনধারা শুরু হয়। এবং মাওলানা বদিউজ্জামান সাহেবের কাছে গুলিস্তাঁ, বোস্তাঁ, আহসানুল কাওয়ায়েদ, জামালুল কোরআনসহ আরো অনেক কিতাব পড়েন।
ধারাবাহিকভাবে তিনি তাঁর প্রিয় ওস্তাদ মাওলানা সাহবান মাহমুদ সাহেবের কাছে আরবি ভাষায় রচিত দরসে নেজামির মি‘য়ারী কিতাবগুলো পাঠ করেন। তার মধ্যে প্রতিধানযোগ্য কয়েকটি কিতাব হলো: নাহবেমীর, ইলমুস সীগাহ, হেদায়েতুন্নাহু, শরহে মিয়াতে আমেল, কাফিয়া, শরহে জামী, কুদূরী, মুফিদুত তালেবীন ইত্যাদি।
এভাবে তিনি দরসে নেজামীর বাকি কিতাবগুলো বড় বড় ওস্তাদগণের সান্নিধ্যে থেকে শেষ করেন। তাহক্বীকের মেজাজ তাঁর ছাত্রজমানা থেকেই ছিল। যার কাছে ‘মাকামাতে হারীরী’ কিতাবটি পড়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাহক্বীকি মেজাজের একজন কামেল ওস্তাদ। সেই সুবাদে যুবক তক্বীর বাবার কুতুবখানার সবগুলো কিতাব দেখার এবং পড়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
তাঁর ভাই-বোনদের মধ্যে কেউ কেউ কাব্যচর্চা করতেন। তাদের সোহবতে থেকে তিনিও কাব্যচর্চায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
পরীক্ষার মধ্যে বেশিরভাগ কিতাবে তিনি মূল নম্বরের চেয়ে বেশি পেতেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, তাঁর চেষ্টা-মেহনত ও তাহক্বীকের ক্ষেত্রে যওক-শওক কতটা ছিল!! যা এ জামানার ছাত্রদের মাঝে খুব একটা পাওয়া যায় না।
কোন মন্তব্য নেই