আজ বৃহস্পতিবার। সকাল আট’টা বাজছে, একটু পরেই মাদ্রাসা ছুটি হবে। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা গতকাল শেষ হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হলে ছাত্রদের মনে যে কি আনন্দ অনুভব হয় তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না! আমার সাথেও ঠিক এমনটাই ঘটে। কিছুক্ষণ পরেই ছাত্ররা আপন গৃহে ফিরে যাবে। সেখানে তাদের পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সহ অনেকের সাথে দেখা হবে। এসব ভেবে অনেকেই আনন্দিত হচ্ছিল। আমার অনুভূতিটাও এমন। সকলেই একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। আমিও সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাদ্রাসা ছুটি হয়ে গেল। আমি বের হয়ে পড়লাম। তবে বের হতে হতে প্রায় দুপুর তিনটা বেজে গিয়েছে।
আমার বাড়ি চট্টগ্রাম। এখন যদি গাড়িতে উঠি, যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। কী আর করার? বাড়িতে তো যেতে হবেই। আমি গাড়িতে ওঠার জন্য ঢাকার সায়দাবাদ টিকেট কাউন্টারে গেলাম। সেখানে কাউন্টারের লোকদের সাথে কথা বললাম; তারা বলল, চট্টগ্রামের কোন বাসের টিকেট নেই। আমি এই এ কথা শুনতেই হতাশ হয়ে গেলাম। কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেখানে বসে বসে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়।
সায়দাবাদ থেকে একটু সামনে গেলেই মাইক্রো-স্ট্যান্ড। ওখান থেকে মাইক্রোযোগে চট্টগ্রাম যাওয়া যায়। আমি সেখানে গেলাম, একটি গাড়িও পেয়ে গেলাম। তো, ভাড়া করে উঠে পড়লাম গাড়িতে। তখন দুপুর চারটা, এক ঘন্টা পরেই আছরের নামাজ, ভাবলাম রাস্তায় নামাজ আদায় করে নিব।
যাই হোক অবশেষে রওনা হলাম চট্টগ্রাম অভিমুখে। প্রায় দু’ঘণ্টা পর কুমিল্লায়এক হোটেলের সামনে এসে থামলো মাইক্রোটি। সেখানে কিছু খেয়ে আবার রওনা হলাম। ড্রাইভারের পাশে বসায় স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে টুকটাক কিছুকথা হল। কথাবার্তার একপর্যায়ে আমার মনে হলো লোকটা তেমন সুবিধার না, আচার ব্যবহার আমার কাছে মোটেও ভালো মনে হচ্ছে না। যখন ফেনী পার হচ্ছিলাম তখন লোকটা এমন এক জায়গায় গাড়িটি থামালো, যেখানে রাস্তার দু’পাশ গাছপালায় ভরপুর। চারদিকে অন্ধকার, মনে হয় রাত ন’টা বাজে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—ভাই কী হলো, গাড়ি থামালেন, কেন?
—ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে।
—ভাই দ্রুত নেমে দেখেন তো কী সমস্যা?
সে নামার পর আমিও গাড়ি থেকে নামলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মুখোশ পরিহিত বেশ কিছুলোক এসে আমাকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলল। ভয়ে আমি কাঁপতে কাঁপতে আল্লাহকে ডাকা শুরু করলাম। এরপর ভীত কন্ঠে কয়েকবার ড্রাইভারকে ডাকলাম। তবে কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার ফিরে এলো। সে আসা মাত্রই সবাই একটু পিছনে সরে গেল। এটা দেখে আমি অবাক হলাম, সে হাসতে হাসতে বলল,
—কী অবাক হলেন নাকি?
লোকটিকে সুবিধার মনে হয়নি সত্য, তবে এমন দৃশ্য দেখার জন্য তেমন একটা প্রস্তুত ছিলাম না। আমার বুঝতে দেরী হলো না, ড্রাইভার লোকটাই এ দস্যুদলের প্রধান। তারা আমার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে, সাথে থাকা সমস্ত টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিল। এরপর এ নির্জন জায়গায় আমাকে একা ফেলেই চলে গেল। গাড়িতে আসলে কোনো সমস্যা ছিল না। আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য এটা তাদের একটা বাহানা ছিল।
আমি এখন কী করব? সেটা নিয়েই ভাবছি। একটু সামনে যেতেই বাজারের দেখা পেলাম। সেখানে একটা চায়ের দোকান খোলা ছিল। দোকানদারকে আমি সব কিছু বললাম। তিনি আমাকে তার মোবাইলটা দিলেন। আমি বাসায় ফোন দিয়ে বাবাকে বিস্তারিত বললাম। বাবা বললেন, আমি যেন সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। বাবা দোকানদারকে অনুরোধ করলেন, আমাকে তার সাথে রাখার জন্য।
এরপর, আমি দোকানে স্থির হয়ে বসে দোকানদারের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। তার কাছে আমার সব ঘটনা বলায় তিনি আমাকে বললেন, এখানে প্রায়ই এমন হয়। যারা মাইক্রোতে যাতায়াত করে প্রায়ই তাদের সাথে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। অনেককে আবার মেরেও ফেলে।
তার সাথে এসব বিষয়ে কথা বলতে বলতে ফজরের আজান ভেসে আসে মসজিদের মিনার থেকে। আমি ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা এসে হাজির হলেন। এরপর বাবার সাথে রওনা হয়ে গেলাম। আল্লাহর রহমতে এক পর্যায়ে বাড়িতে পৌঁছে গেলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন