চার কোণে শুধু গুনগুন পড়ার শব্দ। দিনকয়েক বাদে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সালানা ইমতেহান। কিন্তু পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অজান্তেই মনের গহীনে এক আনন্দ মৃদুভাবে দোলা দিয়ে যায়। কিসের এত আনন্দ? কারণটা.. লিখবো বলেই তো কলম ধরেছি।
পরীক্ষার পর দিন সকালেই প্রায় ১০-১৫ জন মিলে ভ্রমণে যাচ্ছি। এক লম্বা সফর। প্রথমে সীতাকু-, তারপর চট্টগ্রাম শহর, কক্সবাজার, শেষে টেকনাফ হয়ে সেন্টমার্টিন দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে এ সফরের। কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো বা সাগরের বুকে, আবার কখনো প্রবালদ্বীপে।
চিন্তাভাবনার অবসান ঘটিয়ে উক্ত দিনটি দরজায় কড়া নাড়ছে। রেডি হয়ে বসে আছি, শুধু সময়ের সামান্য ব্যবধানের অপেক্ষা।
সফর শুরু হলো দু’রাকাত সালাত এর মাধ্যমে। চক্কর দিতে শুরু করলো ‘আল মাদানী’ পরিবহনের চাকা। ধীরে ধীরে আড়াল হতে লাগলো ব্যস্ত নগরী ঢাকা, নিকটবর্তী হতে লাগলো চট্টগ্রাম বিভাগ। বিরতিহীন ভাবে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার পথ অতিক্রম করে যাত্রা বিরতি করল সীতাকু-ে।
দুপুরের খাবার ও নামাজ আদায়ের পর শুরু করলাম চন্দ্রনাথ বিজয় অভিযান। প্রাথমিকভাবে ভড়কে গেলেও আবার নতুন রূপে শক্তি সঞ্চালন করে পূর্ণ উদ্যমতার সাথে আল্লাহ্র নামে উঠতে লাগলাম। আলহামদুলিল্লাহ দু’ঘন্টায় অতিক্রম করতে সক্ষম হলাম। চন্দ্রনাথের চূড়ায় পা রেখে সীতাকু-কে যেন পাহাড়ের রাজ্য বলে মনে হল। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। মাঝেমধ্যে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে কিছু ঘরবাড়ি। পশ্চিম আকাশে সূর্যের আলোতে দৃষ্টিগোচর হল ‘বে অফ বেঙ্গল’। বিলাপের বিষয় হল সম্পূর্ণ পাহাড় জুড়ে শুধু পৌত্তলিকদের আনাগোনা। বলা বাহুল্য পাহাড়ের চূড়ায় দুটি মন্দিরও রয়েছে।
নেমে আসতে চারিদিক প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। নামাজের কোনো ধরনের ব্যবস্থা না থাকায়, সীতাকু- বাজারে ফিরে নামাজ আদায় করতে হলো। বিকেলের হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। গাড়ি চলল চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে। রাত দশটা পর্যন্ত ‘বায়জিদ বোস্তামী মাজার’ সহ শহরের অলিতে গলিতে ঘোরাঘুরি করলাম।
দশটার পরে ছুটে চললাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে প্রায় রাত দু’টা বেজে গেল। পূর্ব থেকে হোটেল বুকিং দেয়া ছিল। দুই-তিন ঘণ্টার জন্য শরীরকে এলিয়ে দিলাম দিনের সকল ক্লান্তি নিয়ে। আশ্চর্য! এই দু-তিন ঘন্টার বিশ্রাম যেন সারাদিনের সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে দিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়; ফজরের জামাতটা হাতছাড়া হয়ে গেল। সৌভাগ্য যে ক্বাজা হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ।
ফজরের পরের আবহাওয়া আর সুগন্ধা বিচের পরিবেশ যেন বাধ্য করল মুগ্ধ হতে। সমুদ্র থেকে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তীরে উঠে আসছে শামুক আর ছোট ছোট ঝিনুক। প্রভাতের হাওয়া দেহে জড়িয়ে এক পাশে পাহাড় অপর পাশে সাগর এর রাস্তা ধরে মেরিন ড্রাইভে গেলাম হিমছড়িতে। হিমছড়ির পাহাড় থেকে সমুদ্রকে বেশ সুন্দর মানায়। পাহাড়ের একদিকে আছে ছোট একটি ঝর্ণা। তবে কেউ না জানাে বোঝবার উপায় নেই।
প্যারাসেলিং করার খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, বাতাস অনুকূলে না থাকায় বিসর্জন দিতে হলো এ ইচ্ছেটাকে। দীর্ঘ সময় ধরে বিচে ভিজলাম। লাঞ্চের পর পুনরায় বিচে ছাতার নিচে বসে ভাব জমালাম সমুদ্রের সাথে।
আসরের পর দেখা গেল দর্শনার্থীদের ভিড়। প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত ছিল এর ধাক্কা। মাগরিবের পর গেলাম সার্কের সাক্ষাতে ‘ফিস ওয়ার্ল্ড’ এ। এটাকে এমন কাঠামোতে তৈরি করা হয়েছে যে, দর্শকরা ঘুরতে ঘুরতে কখন যে চতুর্থ তলায় এসে পড়ে তার হদিস দেশ পাওয়া বড় দুষ্কর। আর চতুর্থ তলায় দেখা মেলে সার্কের সাথে। ডানে বায়ে উপরে এবং নিচে পুরোটাই মোটা কাচের তৈরি অ্যাকুরিয়াম। সার্কসহ হরেক রকমের মাছের দেখা মিলল, যেগুলোর নাম আমার জানা নেই। আল্লাহর কি অপূর্ব সৃষ্টি। সুবহানাল্লাহ্!
হোটেলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গে॥ ডিনার করলাম ‘টুনা ফিসের’ বারবিকিউ, সাথে নান। সাগরের মাছের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। নদীর মাছের সাথে তুলনাই হয় না। রাতের সমুদ্র এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ আর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ নতুন আরেক প্রকৃতি সৃষ্টি করে।
সবশেষে ফিরে এলাম হোটেলে। পরদিন সকাল ছয়টায় গাড়ি আসবে হোটেলের গেইটে। টেকনাফ পর্যন্ত যেতে হবে গাড়িতে। তারপর ন’টায় শিপ ছেড়ে যাবে সেন্টমার্টিন এর উদ্দেশ্যে। বলে রাখা ভালো, ‘ট্রাভেল কিং’ থেকে শিপের টিকেট বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। যদ্দরুন ঘাটে গিয়ে কোনোরকম বেগ পোহাতে হয়নি। সময়মতো ‘বারো আউলিয়া শিপের’ নিকটে পৌঁছে গেলাম। নয়টায় টেকনাফ অতিক্রম করল। যখন নদী পেরিয়ে সাগরের বুকে পড়ল, ধীরে ধীরে পানির রং পাল্টাতে লাগলো। এক সময় নীল বর্ণ ধারণ করল। বামদিক দিয়ে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল বার্মার বর্ডার। মাঝেমধ্যে সামনে ভেসে উঠছিল ‘জেলিফিশ’। জাহাজের চারিদিক দিয়ে উড়ছিল শত শত গাংচিল। দর্শকরা স্বচ্ছন্দে খাবার খাওয়াচ্ছিলেন পাখিদের। যখন জাহাজ মোটামুটি মাঝ সমুদ্রে আসলো; দেখা মিলল, বিশাল আকৃতির ঢেউয়ের।
ঘন্টার দুয়েক পর দেখা মিলল আবছা আবছা কিছু একটা। যতই কাছে এগোচ্ছিলাম সেটা তত স্পষ্ট হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, এটা তো আমাদের সেই স্বপ্নের ‘সেন্টমার্টিন’। রোমাঞ্চকর বিষয়ে হলো আমার এক পা দ্বীপের মাটিতে, এমন সময় মোবাইল এর নোটিফিকেশন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকাতেই দেখি আমার পরীক্ষার আমলনামা। ফলাফল মোটামুটি ভালোই করেছিলাম। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পা রাখলাম স্বপ্নের দ্বীপে। না বললেই নয় ‘ছেঁড়া দ্বীপ’ও কোন গুনে কম নয় সেন্টমার্টিন থেকে।
সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করলাম দ্বীপের রানী। সেন্টমার্টিন এর বিচগুলো কক্সবাজার থেকে কয়েকগুণ সুন্দর। ঘাটে ঘাটে নগর করে রাখা হয়েছে মাছ ধরার নৌকা। ছোট ছোট ঢেউ একদম নীল পরিস্কার পানি সত্যিই বৈচিত্রময়। দুপুরে ‘ফ্লাইং ফিশ’ আর রাতে ‘কোরাল ফিস’ দিয়ে ভোজ করলাম। দ্রব্যাদির মূল্য তুলনামূলক অনেকটাই বেশি মনে হল। যার দরুন খরচের পরিমাণটাও একটু বেশি হল। পরদিন সকালের ছেঁড়া দ্বীপ সহ বাংলার একদম দক্ষিণ পাড়ে পা রাখার সুযোগ হলো। সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু পানির সমারোহ।
মুগ্ধ হলাম; এখনো সেন্ট মার্টিনে টিকে আছে ইসলাম। গড়ে উঠেছে মাদ্রাসা, মসজিদ, পাশাপাশি উচ্চ বিদ্যালয়ও রয়েছে। প্রতিটি ছাত্রীর গায়ে জড়ানো সাদা গোল বোরখা, মুখে কালো হিজাব। এ যেন একজন জান্নাতি পরিবেশ, যা আজ পর্যন্ত কোনো স্থানে আমি দেখিনি। ধন্য তুমি সেন্টমার্টিন। সালাম তোমার বুকে যাদের বিচরণ। সালাম যাদের মেহনতে আজ এ পর্যন্ত। আল্লাহ তোমাকে সব ধরনের কূটচাল থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
তখন সূর্য মাথা বরাবর চলে এসেছে। ফিরে নামাজ ও খাবার থেকে অবসর হয়ে চড়ে বসলাম বারো আউলিয়া শিপে। তিনটার দিকে বিদায় জানিয়ে ফিরে চললাম গন্তব্য পানে। আবার হয়তো দেখা মিলবে জীবন চলার পথে, কোনো প্রয়োজনে। লম্বা পনেরো ঘন্টা জার্নি করে, আবার ফিরে এলাম ঢাকায়।
এখনো সেন্টমার্টিনের কথা মনে পড়তে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে অন্তর।
ধন্য তুমি, ধন্য তোমার ভূমি!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন