ইনভেস্টিগেশন ৩
উদ্দেশ্য আবদুল্লাপুর। স্টাফ কোয়ার্টার সড়কে গিয়ে আব্দুল্লাহপুরের বাসে চড়ে বসলাম। যাওয়ার পথে যমুনা ও নতুন বাজারের মাঝখানে খ্রিস্টানদের একটা স্কুল দেখতে পাই। একেবারে মূল রাস্তার সাথে স্কুলটি। এর নাম হচ্ছে, সেন্ট ইউজিন্স স্কুল। নামের নিচে লেখা ‘বাংলাদেশে অবলোটদের আগমন’। স্কুলের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৩ সাল। একপাশে পাদ্রীর ছবি দেওয়া ছিল। নিচে আমাদের দেশের সাবেক অপ্রিয় নেতা, সেতু অপমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছবি দেওয়া। বোঝা যাচ্ছে সরকারের মদদপুস্টেই এসব।
অবশেষে যোহরের পর আব্দুল্লাহপুর পৌঁছলাম। নামাজের পর ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করি, এখানে আশেপাশে একটা খ্রিস্টান এলাকা আছে? তিনি স্বাভাবিকভাবে বললেন,
- সামনে গিয়ে ময়নারটেক এর গাড়িতে উঠবেন। কিন্তু, কেন যাবেন?
- এমনি।
- কোনো কিছু বিক্রি করবেন?
- না।
ইমাম সাহেবের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে গেলাম। একটা মিশুক ভাড়া করলাম ময়নারটেক যাওয়ার জন্য। সেখানে পৌঁছে একটা অটোতে উঠলাম। বললাম, খ্রিস্টানপাড়ায় যাব। (এলাকাটার নামই খ্রিস্টানপাড়া) অটোওয়ালা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
- কোথায় যাবেন?
- খ্রিস্টানপাড়ায়।
- খ্রিস্টানপাড়ার কোথায়?
- খ্রিস্টানপাড়ার শুরু দিয়েই।
- আপনাদের কি তাহলে শুরুতে নামাবো?
- হ্যাঁ।
- কারো বাসায় যাবেন?
- কারো বাসায় না। উত্তরখানে আমার এক বন্ধুর বাসা আছে। সে ওই জায়গায় আসবে বলেছে। তার বাসায় যাব।
- ফোন করেও তো সরাসরি তার বাসায় যেতে পারেন।
- আসলে আমাদের সাথে কোনো ফোন নেই। এজন্য সে বলেছে ওই জায়গায় থাকতে। পরে সে নিয়ে যাবে।
আমি চাচ্ছি তার সাথে কথা না বলতে। আর সে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
- এই জায়গা থেকে খ্রিস্টানপাড়া শুরু। এখানে নামবেন?
- আরেকটু ভিতরে যান।
- শুরুতে নামবেন বলেছেন। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
- আচ্ছা ভাই নামিয়ে দেন।
লোকটা সম্ভবত খ্রিস্টান। একটা দোকানের সামনে নামলাম। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। তাই দোকানের সামনে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। পাশের দেয়ালে একটা কাগজ লাগানো দেখতে পেলাম। লক্ষ্য করলাম, ফুটবল টুর্নামেন্টের তালিকা। বিভিন্ন হিন্দু-খ্রিস্টান দল। বৃষ্টি কিছুটা কমলে সামনে হাঁটা ধরলাম। হাঁটতে হাঁটতে এলাকার শেষ মাথায় চলে এলাম। এখানে একটি নদী। আশপাশে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। দূর থেকে অটোওয়ালা দেখে ফেলল। পাশের অটোওয়ালাকে কিছু বলল হয়তো। সাথী আমাকে বলল, ভাই সন্দেহের তীর নিক্ষেপ হয়ে গেছে। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। ঠিক বলেছেন। কারণ, একটু আগে বলেছি আমাদের এক বন্ধু আসবে। কিন্তু আমরা ঘোরাঘুরি করছি। এটা অবশ্যই সন্দেহ সৃষ্টি করছে।
পূর্বে একটা সংস্থার নাম দেখতে পেয়েছিলাম। আবারো একটা দেখতে পেলাম একই নামের। যতটুকু বুঝতে পারলাম, এটা হচ্ছে একটা ব্যবসায়িক সমিতির। সাথী বলল, চলেন এই গলি দিয়ে একটু ভিতরে যাই। একটা স্কুল দেখতে পেয়েছি। ভেতরে গিয়ে দেখি একটা স্কুল। ১৮৮৬ সালে স্থাপিত। ব্রিটিশ আমলের। স্কুলের নাম ‘ময়নারটেক প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
সামনে পথ ধরলাম। সেই সমিতির আরেকটা শাখা দেখা গেল। এর থেকে মানুষকে ব্যবসার জন্য টাকা, ত্রাণ ইত্যাদির তাদের কাজ করে। সামনে একটা গির্জা। ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে মহিলাদের। শোনে বোঝা যাচ্ছে, এটা তাদের ইবাদতের আওয়াজ। গির্জাটির নাম হচ্ছে ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি মাদার তেরেসার্স সিস্টার্স’। মোটামুটি বড় একটা বাড়ির ভেতরে।
আবার খ্রিস্টানপাড়ার শুরুতে চলে এলাম। উত্তর পাশে আরেকটা রাস্তা। এখন সেই রাস্তা ধরলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখি একটা বিরাট বালুরমাঠ। রাস্তার একপাশে পুরোটাই বাউন্ডারি দেওয়া। শেষ মাথায় এসে বুঝতে পারলাম, এখানে একটা বড় গির্জা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। এখনো উদ্বোধন হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার। আগামী শনিবারে উদ্বোধন হবে। শেখ হাসিনাকে দাওয়াত দিয়েছে। মাঠে কয়েকজন ছোট ছেলেকে দেখতে পেলাম। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ওই স্কুলটায় বেশি ছাত্র ছাত্রী নেই। কারণ, ফ্যান নষ্ট, লাইট নষ্ট। সরকারের পক্ষ থেকে টাকা আসলেও সেগুলো তাদের শিক্ষকদের পেটে চলে যায়।
এই এলাকায় হিন্দু, খ্রিস্টান উভয় ধর্মের মানুষ থাকে। তবে খ্রিস্টানদের প্রভাব বেশি। আসলে ভাবতেও পারিনি যে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মধ্যে খ্রিস্টানপাড়া নামে কোনো এলাকা আছে। কয়েকজনকে বলার পর তো অবাক হয়ে গেছে যে, ঢাকার মধ্যে এমনও এলাকা আছে।
তাও আমাদের চোখ খুলছে না। দিন দিন এদের অনুসারী সংখ্যা, গির্জার সংখ্যা, দাওয়াতের কার্যক্রম, তাদের স্কুল সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ৫৫০০ এর বেশি গির্জা রয়েছে। আমরা যদি তাদের ব্যাপারে সচেতন না হই। তবে অনেক দেরি হয়ে যাবে, যখন আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।
অনেকে ভাবতে পারেন! আরে খেলাফত প্রতিষ্ঠা হয়ে যাক শুধু। সব করব। সম্ভাবনা শত বছর ধরে চলে আসা একটা ধর্মকে আপনি কয়েকদিনেও নিশ্চিহ্ন করে দিবেন সম্ভাবনা আর ফেরার পথ আপনি কিভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন?
নারায়ে তাকবীর বলবেন আর আল্লাহু আকবার বলে খেলাফত প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে! একটা দেশের শত বছরের রাজনীতি সংস্কৃতি আপনি কয়েক দিনে পরিবর্তন করে দিবেন, এটা সম্ভব না। এটা আফগানিস্তান নয় যে, শুরু থেকে আমরা জিহাদ নিয়ে আছি। আর জিহাদের জন্য ডাক দিলে সবাই এসে পড়বে। বরং মানুষ আজকে জিহাদ বললে সন্ত্রাস বোঝে। দেশের প্রায় ৬০ থেকে ৭০% মানুষ আজকে ইসলামী খেলাফত গ্রহণ করবে না। কিন্তু আফগানিস্তানের মানুষ সবাই জিহাদপ্রিয় ছিল। মূর্খ থেকে শিক্ষিত সবাই। তাই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তাই যদি আমরা মানুষকে আগে থেকে প্রস্তুত না করি আর ধর্ম অন্য ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে সোচ্চার না হই তাহলে বাংলাদেশের সব মিলিয়ে আমাদের আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই জাতি আজকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারছি না।
মনে রাখবেন! কোনো জাতী, গোষ্ঠী— গোত্র সভ্যতা বা সংস্কৃতি ছাড়া থাকে না। যখন উসমানী খেলাফত ছিল তখন মুসলমান ইসলামী সভ্যতা গ্রহণ করেছে। যখন উসমানী খেলাফত ধ্বংস হয়ে গেল, ঠিক তখনই পশ্চিমারা মানুষের সামনে তাদের সভ্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। আর না চাইতেও মানুষ সেটা গ্রহণ করেছে। আজকে সচেতন মানুষ পশ্চিমা সভ্যতা থেকে আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এখন যদি আমরা আমাদের মধ্যকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসলামকে মানুষের সামনে ফুটিয়ে তুলতে পারি এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারি তাহলে বাংলার ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে মনে রাখতে হবে, সময় খুব সংক্ষিপ্ত। অন্যথায় যদি আমরা সচেতন না হই, হতে পারে আরো এক যুগ পেরিয়ে যাবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে নিজ অবস্থান থেকে সোচ্চার হয়ে রেযায়ে ইলাহীর নিয়তে ইসলাম পৃথিবীবাসীর সামনে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার তৌফিক দান করুক। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই