উইঘুরের আর্তনাদ
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি একটি ভূখণ্ড। আকাশ থেকে নেমে আসা চনমনে রোদের বিকিরণ, তুষার মাখা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ পানির প্রসবন। কি নেই এখাোনে! দুনিয়ার বুকে যেন এক টুকরো জান্নাত। উইঘুর, এই নামটি হয়তো সবার পরিচিত নয়। আমরা কাশ্মীরে মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের কথা জানি, আরো জানি মায়ানমারে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমরা উইঘুরের মুসলিমদের কথা জানিনা। বিশ্বের যে সকল স্থানে মুসলিমদের রক্ত ঝরছে অন্যতম হলো উইঘুর। এর পূর্বনাম হচ্ছে ‘পূর্ব-তুর্কিস্তান’। এখানকার প্রাচীন শহরের নাম হলো ‘কাশগড়’। প্রাচীনকালে আরবের কাফেলাগুলোর যাতায়াত ছিল এখানে। সেই সুবাদে ৮৩ হিজরীতে আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান এর মাধ্যমে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ধীরে ধীরে মুসলমানদের জনবসতি গড়তে থাকে। ১৮৭৬ সালের আগ পর্যন্ত এখানে মুসলিম সাম্রাজ্য ছিল। কিন্তু সে বছর কাশগড়ে মাঞ্ছু রাজা আক্রমণ করে বসে। দীর্ঘ আট বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। পরে ১৮৮৪ সালের ১৮ই নভেম্বর তুর্কিস্তানের পতন হয়। এবং মাঞ্ছুর রাজবংশ সবকিছু দখল করে নেয়। জবরদখলের পর নাম রাখা হয় ‘জিনজিয়াং’ যার অর্থ- নতুন ভূমি।
চীনের সরকার উইঘুরদের ভাষা, সংস্কৃতি সমূলে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। ১৯১১ সালে চীনব্যাপী জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু হয়। অন্যান্য অঞ্চলের মতো পূর্ব তুর্কিস্তানও জাতীয়তাবাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তখন থেকেই উইঘুররা স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করে। ১৯৩৩ ও ১৯৩৪ সালে দুইবার তারা স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্টদের বিপ্লবের ফলে অন্যান্য গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কমিউনিস্টরা উইঘুরে চূড়ান্ত আঘাত হানে। যার ফলে উইঘুর জাতি পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়। এই ৭৫ বছরে তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
চীনের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হলো হান। এই হান যুবকরা উইঘুরের যুবতী মেয়েদেরকে জোরপূর্বক বিবাহ করে ঘর সংসার করে। কেউ বাঁধা দিতে আসলে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বন্দী শিবিরে। চীনা সরকার সেখানে উইঘুরদের নির্যাতনের জন্য তৈরি করে রেখেছে অজস্র বন্দীশিবির। উইঘুরদের জন্য ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, মেসেঞ্জার সব নিষিদ্ধ। যাতে করে তাদের খবর কেউ জানতে না পারে। কারো মোবাইলে এগুলো পাওয়া গেলে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় জালিমের বন্দীশিবিরে। চাইনিজরা প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে আছে। তারা উইঘুর এলাকায় প্রায় ১৭ কোটি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে। ২০৩০ এর মধ্যে ৩০ কোটি ক্যামেরা লাগানোর পরিকল্পনা করেছে তারা। ভাবা যায়, দুই কোটি মানুষের জন্য ৩০ কোটি ক্যামেরা!! ভাবছেন এত ক্যামেরার এত খরচ সরকার কিভাবে বহন করে? খরচ তো খুব সামান্যই, কেননা এই ক্যামেরাগুলো বানাতে কোনো প্রকার শ্রমিক-মজুর লাগে না। বন্দীশিবিরে যে তিন লক্ষ কয়েদি বন্দী আছে তাদেরকে দিয়ে এগুলো বানানো হয় বিনা পারিশ্রমিকে। আমরা যে চায়না ব্যান্ডের পণ্য এত কম দামে পাই, তার কারণ হলো এটা। বড় বড় কোম্পানি যেমন- Nike, Adidas, Apple, তারা তাদেরকে দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে নিজেদের পণ্য তৈরি করিয়ে থাকে। এমনকি দিনশেষে তাদেরকে এক মুঠো খাবারও দেয়া হয় না। পৃথিবীর সব বিরল প্রজাতির রক্ত কিডনি একমাত্র চীনেই পাওয়া যায়। তাও একদম স্বল্পমূল্যে। আপনি জানেন এগুলো কোত্থেকে আসে!! তা আর কারো নয়, উইঘুর মুসলিমদের। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানি তাদের ওষুধের কোন প্রকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় তাদের ওপর। এতে অনেক মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। থাকলে কি হবে? চীনাদের কাছে তাদের জীবন মূল্যহীন। চীনারা উইঘুরদের ভাতে মারছে, চিকিৎসায় মারছে, ধর্ষণ করে মারছে। একজন মানুষকে যতভাবে নির্যাতন করা যায় সব পদ্ধতি তারা প্রয়োগ করছে।
প্রিয় পাঠক,
এগুলো দূর-ইতিহাসের কোনো বর্ণনা নয়, একবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ব্যক্তি-স্বাধীনতার যুগের ঘটনা। আপনি আমার লেখাটা যখন পড়ছেন ঠিক এই মুহূর্তে আপনার কোনো উইঘুর বোনকে ছিন্নভিন্ন করে খাচ্ছে বা কোনো ভাইয়ের কিডনী খুলে বিক্রি করছে!
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে আরসালান নামক এক ব্যক্তি অনলাইনে একটি জুতা অর্ডার করেছিল। অর্ডার হাতে পৌঁছার পর তাতে একটি গোপন চিরকুট দেখতে পায় সে। তাতে লিখা ছিল- Help! I am in Jail in China pls (Please) help Uyghur!
পরিশেষে বলতে চাই, এই অসহায় লোকদের উদ্ধারের ব্যাপারে দোয়া ছাড়া কিছুই করার নেই আমাদের। তাই আমরা যত পারি তাদের জন্য দোয়া করতে থাকব।
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করেন। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই