ফ্যাসিবাদের লানত
১.
একটি ভয়াতুর সন্ধ্যায় ভর করে পৃথিবীতে রাত্রি নেমে এসেছে। শহুরে যান্ত্রিকতা আর ইট-পাথরে মোড়ানো প্রতিটি দালানে বিরাজ করছে অঘোষিত নিস্তব্ধতা।
এমনই নিঃশব্দতায় উদ্বেগাকুল মনে বসে আছেন হামিদা বেগম। অনেক রাত হয়ে গেছে। ছেলের খবর নেই, স্বামীরও খবর নেই। স্বামীর খবর না থাকাটা যৌক্তিক। তিনি পুলিশে চাকরী করেন। নানান ব্যস্ততা। এর ওপর আবার ছাত্ররা কোটা সংস্কারের জন্য ময়দান উত্তপ্ত করে তুলেছে। পরিস্থিতি ক্রমেই সরকারের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সরকারকে পরোক্ষ শেল্টার দেয়ার দায়িত্ব পুলিশের ওপরই। কিন্তু ছেলে কেন এই রাত-বিরাতে ঘরের বাইরে থাকবে?
সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, আশেপাশের সব স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। তার ছেলে সজিবও আছে এই দলে। তিনি এ কথাও শুনেছেন, সজিব আন্দোলনের নেতৃত্ব পর্যায়ের একজন। এসব খবর হামিদা বেগম জানেন। তিনি স্বামী সারোয়ার সাহেবকেও কিছু কান করেছেন। কিন্তু স্বশব্যস্ত সারোয়ারের শুধু এক কথা- “দেখো হামিদা, এইটা কিন্তু ছেলে খেলা না। সরকার সর্বশক্তি দিয়া এই আন্দোলন দমন করবে। আমাদের মাধ্যমেই। সময় থাকতে সজীবকে বুঝাও। ও তো এখন আর ছোট নেই।”
হামিদা বেগম কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি সজীবকে বারবার ফোন দিচ্ছেন। কিন্তু ফোন ঢুকছে না। ব্যর্থ হয়ে সারোয়ার সাহেবকে ফোন দিলেন। তিনিও রিসিভ করছেন না। মনে হয় ডিউটিতে আছেন। আগামীকাল নাকি বড় আকারে আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ থাকবে। তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। সবকিছু তার কাছে শূন্য ঠেকছে। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগলো। একটা গুমোট নিরবতা এবং কান্নার চাপা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল পুরাে ঘরজুড়ে।
২.
নীলক্ষেত মোড়ে আশেপাশের সব ছাত্র-জনতা জমায়েত হতে লাগলো। আজকের কর্মসূচিটা একটা দুঃসাহসিক কর্মসূচি। পুরো দেশে “কমপ্লিট শাটডাউন”। সরকারের জন্য এটা ভয়াবহ বার্তা। “পথের কাঁটা” সমূলে উৎখাত করতে না পারলে গদি থাকবে না এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। সেই অনুযায়ী কঠোর ভাবে "দমনের" প্রস্তুতিও নিয়েছে বোধহয়। ছাত্ররাও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে নয় দফা দাবি শুধু মুখের গর্জনে মানানো যাবেনা। অধিকার আদায়ের জন্য এবার রক্ত ঢালতে হবে। অন্তরে তাদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। বুকে আকাশসম সাহস। লাল-সবুজের পতাকা মাথায় দিয়েছে ওরা। বারেবারে স্লোগানে মুখরিত করছে রাজপথ- “আসছে ফাগুন, আমরা হব দ্বিগুণ”।
পুলিশের হেল্পলাইনের ওপর দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছেলে হ্যান্ডমাইক দিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের পূর্ণ নির্দেশনা দিচ্ছে। সজীবও তাদের একজন। সজীবের হাতে হ্যান্ডমাইক আসলো। প্রথমে সে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করল। অদ্ভুত গম্ভীরতায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা, বাতাসে দ্রোহের ছড়াছড়ি। শহীদি তামান্নায় টগবগিয়ে উঠছে প্রতিফোটা রক্ত। বিদ্রোহ... বিপ্লব...
ঠিক সেই মুহূর্তে গুলির গগনবিদারী ঠা.. ঠা.. ঠা.. নিরবিচ্ছিন্ন হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে সবাই। সজীব হ্যান্ডমাইকে বলে যাচ্ছে - “সকলে সিটি কলেজের দিকে যান। আমাদের হেরে গেলে চলবে না।”
৩.
সিটি কলেজ এলাকা উত্তপ্ত। সশস্ত্র পুলিশ-ছাত্রলীগ নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ধাওয়া - পাল্টা ধাওয়ায় এ পর্যন্ত কয়েকটা লাশ পড়ে গেছে। পুলিশ কোনোভাবেই ‘মাঠ খালি’ করতে পারছে না। ফলে ময়দানে থাকা পুলিশদেরকে ডিএমপি থেকে সরাসরি ‘অপারেশন’চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ ভারী অস্ত্র নিয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বন্দুক হাতে সারোয়ার সাহেবও আছেন। তিনি বিলক্ষণ জানেন, এখানে এই আন্দোলনে তার ছেলে সজীব আছে। গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে তিনি এ খবরটা গতরাতেই জেনে গেছেন। একটু পরে আন্দোলনরতদের ওপর জাহান্নাম নেমে আসবে। কিছু করতে না পারলে তার ছেলেও মারা পড়বে। তিনি শেষ চেষ্টাটা করলেন। কিছু 'ভালো' পুলিশকে তিনি বোঝাতে চাইলেন, 'নিরীহ ছাত্রদের এভাবে মারা ঠিক হবে না।' কিন্তু তিনি দারুণভাবে ব্যর্থ হলেন। ক'জনই-বা তার কথা কানে নেবে। সে পরিস্থিতি তো এখন নেই!! ছাত্রলীগের ক্যাডাররা তার এই কথা শুনতে পারলে এখানেই জবাই করে ফেলবে। তিনি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অজানা শঙ্কায় তার বুক দুরুদুরু করছে। কোনো কথা বলতে পারছেন না। পকেটে থাকা ওয়াকিটকি থেকে আওয়াজ ভেসে এলো ‘অ্যাকশন...’ পুরো ফোর্স ঝাঁপিয়ে পড়ল ছাত্রদের ওপর।
মুখোমুখি যাকেই পাচ্ছে, গুলি করে মারছে। আড়াল থেকে খুঁজে খুঁজে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করছে। সারোয়ার সাহেব দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি দু'চোখে ছেলেকে খুঁজছেন। ক্লান্তিতে হাঁসফাঁস করছেন। তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। তিনি দূর থেকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন একটা ছত্রভঙ্গ দল এবং সজীব...! তারা দৌঁড়াচ্ছে। পিছনে পুলিশ। গুলি করছে। খানিক পরপর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ছে। সারোয়ার সাহেব নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি দৌঁড়ে গেলেন। তার চোখ ঝাঁপসা হয়ে আছে। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তিনি অস্পষ্ট দেখতে পেলেন সজীবের গায়ে গুলি লেগেছে। সে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে। কাছে যেতে পারলেন না। এর আগেই ছিটকে পড়ে গেলেন। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন। চারিদিকে মুহূর্মুহূ গুলির আওয়াজ। মানুষের ছোটাছুটি...। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি চারপাশে তাকিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু পারলেন না। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। নিথর হয়ে পড়ে রইলেন পথের ধারে। কেউ তাকে নিতে এলো না....।
কোন মন্তব্য নেই