অদেখা লোনাজল
১.
ধোঁয়া ধোয়া কুয়াশামাখা ভোর। যেন কিছু দেখা যায়, কিছু দেখা যায় না। এখনো সূর্যের দেখা মেলেনি। গগনপুরে আজ মেঘের দঙ্গল। পরতের পর পরত শুভ্র মেঘের ভেলা উড়ে বেড়াচ্ছে। দিঘীর পাড়ের তালগাছগুলোর পাতা তিরতির করে কাঁপছে। খানিকবাদে জানালার পাশ থেকে উঠে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশজুড়ে মেঘেদের উঁকি ঝুঁকি। রিমঝিম বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টি। ঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির নাচন দেখছি। বিমোহিত চিত্তে তাকিয়ে আছি অপলক। বাইরে সুজলা-সজীব প্রান্তর। যার সমস্তজুড়ে দুর্বাঘাসের সবুজিমা। প্রভাতের বর্ষায় স্নাত হচ্ছে পৃথিবী। মুগ্ধতার রঙমাখা এক অপূর্ব দৃশ্য।
—দৈবাত আমার অবুঝ মনটা কেমন যেন আনচান করে উঠল। ঝাঁপসা বৃষ্টির আড়ষ্টতা ভেঙ্গে-চকিত হয়ে উঠলাম। আপন পাঁজরকে উষ্ণ বাহুডোরে জড়ালাম আবেগের পরম স্নেহে....।
শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টি আমার বড্ড ভালো লাগে। ভেজার শখও হয় প্রবল। কিন্তু পারি না। অজানা কোনো পিছুটান যেন আমার টুটি চেপে ধরে। কেনো জানি তখন চরম বিষন্নতা অনুভূত হয়। গাল বেয়ে নেমে আসে দুটো চিকন ধারা। আঁখি জলে ভেসে যায় বুক। আনমনা হয় ডুব দিই জীবনের গভীরতায়। অচল বিবেকে তখন এক চিলতে শান্তির খোঁজ করি। কিন্তু শান্তি যে এক পূর্ণিমার চাঁদ! অভাগার ললাটে তা জুটবে কোত্থেকে? তাইতো আমি আক্ষেপের নোনা জ্বলে ভাসিয়ে দেই বুক— আহা...! পারতাম যদি জীবনের সমস্ত হাহাকার যন্ত্রণা ভাসিয়ে দিতে শান্ত দিঘীর জলে...!
২.
বিধাতার এক অমোঘ বিধান বলেই মর্তলোকে পালাবদল হয় দিবা-রাত্রির। বেলা ফুরিয়ে সন্ধ্যা আসে। গোধূলি বেয়ে আঁধার নামে। সূর্যিমামাও বিদায় নেন রক্তরাঙা অবয়বে। আদম পাখিরা একে একে পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে। ধরণীময় বিরাজ করে পিনপতন নীরবতা..।
আচমকা ছেদ পড়ে রাতের নিগূঢ়তায়। দূরে... বহুদূরে— মাসজিদের সুউচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসে মায়ামধুর ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হয় নৈশ- আঁধারের ঘনঘটা; সহসা জ্বলে ওঠে প্রত্যুষের সোনালী রবি।
রাত-দিনের এ চঞ্চল পদপাতে যেন ধা ধা করে পালালো দুটি বছর। দু-দুটো বসন্ত। কিন্তু হৃদয় আমার আজও ব্যাথাতুর। অদ্যাপি এ নিষ্ক্রিয় আমি নিজেকে আবিষ্কার করছি দুঃখভরা এক গহীন পাতালপুরে। হৃদয়তন্ত্রীতে অবিরাম বেজে চলছে বিষাদের বীণ। চোখের সরু কোণ বেয়ে অবিরত ঝরছে তপ্ত অশ্রুধারা— যেন তার কোনো অন্ত নেই।
৩.
ব্যথাতুর এই বিক্ষত হৃদয়ে কিঞ্চিত প্রশান্তির প্রলেপ দেয়ার প্রত্যাশা নিয়ে— বলা যায় আকাশসম স্বপ্ন ও বুকভরা আশা নিয়ে আমার নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার প্রিয় সঙ্গী 'কলমের' থেকে হাত বাড়ালাম। হৃদ-মাঝারে সযত্নে পুঞ্জিভূত করে রাখা কিছু অভিব্যক্তি তাকে জানান দেয়ার মর্জি হলো। কিন্তু হায়! নিয়তি বড় নির্মম। প্রিয়তমের কোমল স্পর্শ-পুলকে কলম-চিত্ত যেখানে পুলকিত হবার কথা, সেখানে তার পুরো সত্ত্বাজুড়ে বিষণ্নতার নিগূঢ় প্রতিক স্পষ্ট ফুটে উঠল। একরাশ বিস্ময় নিয়ে তার মুখপানে চাইলাম— চেহারায় রক্তিমতার ছাপ। চুলগুলো উসকো-খুসকো। মুখে রা নেই। পিঙ্গল চোখদুটো জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ; যেন তাকে মনে হচ্ছিল, সাঁঝের বেলা রণাঙ্গনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে থাকা এক ভীষণাহত ক্রুদ্ধ মুমূর্ষযোদ্ধার জ্যান্ত প্রতিচ্ছবি।
অকস্মাৎ গা শিউরে উঠে। বাকরুদ্ধ হই। চেতনা হারাই। নিজেকে আবারও আবিষ্কার করি বিভীষিকাময় এক আঁধার কুঁড়েঘরে।
৪.
ওহে সকল মনন-রাজ্যের নিয়ন্তা!
ওহে সকল হৃদয়-সাম্রাজ্যের সুমহান সম্রাট!
কলুষিত আমার দেহ মন সমস্ত। বিষাদের কৃষ্ণ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আমার হৃদয়-পুষ্পকানন। নেই তাতে পুষ্পরাজির মনমাতানো সুঘ্রাণ। নেই জবা, হাসনাহেনা আর গন্ধরাজের সুগন্ধি। নেই লাল শুভ্র গোলাপের হৃদয়কাড়া সৌরভ।
আছে কেবল তাদের মজে যাওয়া কলিগুলোর কলজেপোড়া গন্ধ। ঝলসে যাওয়া ফ্যাকাসে চেহারা। যাতনার দহনে দগ্ধ বীভৎস রূপ।
হে সুমহান করুণার অধিপতি! দোহাই তোমার করুণার। ব্যথাতুর হৃদয়ের আকুতি শোন হে করুণাময়! তব নূর তাজাল্লীর একটুখানি প্রসাদ লাভের আশায় দুয়ারে তোমার হাত পেতেছে এক অধম ভিখারী। তোমার এক চিরকৃতার্থ দাস।
ওহে জগত-নিয়ন্তা! নিয়তের একি আজব নির্মমতা! কি চরম দুর্ভোগ! কি নির্দয় বাস্তবতা!
প্রভু গো! এ আমার কেমন নিয়তি! অবুঝ মন যে আর প্রবোধ মানছে না। তাই বলি প্রভু! বঞ্চনার দহনে আর দগ্ধ করো না এ অভাগাকে। দোহাই তোমার। তব চরণতলে মাথা গুঁজিয়ে সহস্রবার পানাহ চাচ্ছি। ক্ষমা করো প্রভু!
রেহাই দাও!!
কোন মন্তব্য নেই