বিজ্ঞাপন দিন

মুহাম্মদ স. এর আবির্ভাব; এক নতুন পৃথিবী | আসাদুজ্জামান রকি



তমসাচ্ছন্ন এক পৃথিবী। সভ্যতা সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন আঁধার দুনিয়া। অন্ধকারের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত পুরো বহ্মান্ড। জগৎ সংসার আস্ত একখন্ড নরক যেন; আমগ্ন মূর্খতায় ডুবে থাকা মানব সন্তানেরা একটুখানি আলোর খোঁজে জলহীন মাছের মতো খাবি খাচ্ছে। যেখানে মদ-জুয়া, অশ্লীলতা-নগ্নতা, জুলুম-নির্যাতন ও অন্যায়-অবিচার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, গোত্রে-গোত্রে খুনাখুনি যেখানকার প্রতিদিনের ঘটনা। বসুধরার এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে আবির্ভূত হলেন এক মহামানব। প্রেরিত হলেন পুত-পবিত্র এক সত্তা। যিনি মানবতার দূত, সত্যের প্রচারক, মূর্তির সংহারক; যিনি উভয় জাহানের সরদার, শুদ্ধ ও পবিত্র চিন্তা-চেতনার আধার; যার সুরভিত নাম মুহাম্মাদ স.।


তাঁর আগমনে ঘটে গেল রক্তপাতহীন এক নীরব বিপ্লব, বদলে গেল পৃথিবীর রুসম-রেওয়াজ ও প্রাশাসনিক কাঠামো। মানবতার উত্তরণ ঘটল গ্রীষ্মের খরতাপ, লু-হাওয়া, প্রচন্ড দাহ ও দুর্ভিক্ষঘেরা ভয়ংকর ঋতু থেকে এমন এক ঋতুতে, যেখানে গলাগলি করছে ফুল আর বসন্ত, যেখানে উদ্যান ঘেঁষে বয়ে চলছে ছলছল প্রবাহের উচ্ছল ঝর্ণাধারা।


মুহাম্মদ! যে ব্যক্তিত্বের সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কাছে ভীষণভাবে ঋণী পুরো মানবসভ্যতা। যিনি মানবতার হাতে তুলে দিয়েছেন এক নতুন উপহার যা মানবতাকে দান করেছে নতুন জীবন, নতুন শক্তি ও পথচলার হিম্মত। যার সাধনার বদৌলতে আরব-আজম, মিসর, তুর্কি, ইরান, খোরাসান, আফ্রিকা, স্পেন, হিন্দুস্তান, আলজেরিয়া সবাই পেল তাহযীব-তমদ্দুন, সভ্যতা-সংস্কৃতি, বিদ্যা-বুদ্ধি ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি; সর্বোপরি ন্যায়নিষ্ঠা, আধ্যাত্বিকতা, চরিত্র ও সমাজ গঠনের এক মহোত্তম দর্শন ও ব্যবস্থা।


এখানে মুহাম্মাদ সা. এর পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হবে, যেগুলো মানবজাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে, সংশোধন ও সংস্কারের পথ বাতলে দিয়েছে এবং মানবেতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।


এক. সুস্পষ্ট তাওহীদের আকিদা:

নবীজির সবচে’ বড় অবদান বা অনুগ্রহ হল, তিনি দুনিয়াতে দান করেছেন তাওহীদের আকিদা। স্বচ্ছ, পবিত্র ও নজিরবিহীন এক বিপ্লবী আকিদা। এ আকিদা শক্তি ও বিশ্বাসে ভরা জীবনবোধ থেকে উৎসারিত। এ আকিদা পাল্টে দেয় সব প্রতিকূলতা ও বাধা-বিপত্তি বিনাশ করে দেয় বাতিল প্রভূদের রাজত্ব। এই আকিদা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ দিতে পারেনি। পারবে না কিয়ামত পর্যন্ত।


দুই. সাম্য ও ঐক্য:

নবীজি সা. শতভাবে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত মানব সম্প্রদায়কে ঐক্য ও সাম্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। তাঁর আগমন-পূর্ব সময়ে এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের কোনো সম্পর্ক ছিল না। একতা ও সাম্যবাদ বন্দি ছিল সংকীর্ণতার শেকলে। তারপর মহানবী সা. সবাইকে শুনিয়ে দিলেন সুদীর্ঘকালের নীরবতা ভেঙে দিয়ে এবং স্তরে স্তরে জমে থাকা অন্ধকারকে ভেদ করে সেই বিপ্লবী ঘোষণা, যা শতধা বিভক্ত জাতিকে ঐক্যের বন্ধন ও সাম্যের মৈত্রীতে আবদ্ধ করে দিল।


তিন. মানুষের সম্মান ও মর্যাদার ঘোষণা:

তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন মানবতার সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের শিক্ষা। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে মানুষ ও মানবতা, অপমান 

ও লাঞ্চনার এক দুর্বিসহ জীবনের ওপর অসহায়ভাবে গুনছিল নাজাত বা মুক্তির প্রহর। সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে তিনি অপমান ও লাঞ্ছনার গহব্বর থেকে উদ্ধার করলেন মানবতাকে। দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন, এই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় ও মহান আর কিছু নেই।


চার. নিরাশা থেকে আশার প্রদীপ্ত আলো:

জাহেলীযুগে মানুষ আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছিল। তাদের মাঝে জন্ম নিয়েছিল ‘নিখুঁত মানব প্রকৃতি’ সম্পর্কে এক রকমের পাপবোধ। এই ধারণা মানুষের মন-মগজে বেশ ভালোভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিল যে, মানুষ জন্মগতভাবেই পাপী ও অপরাধী।

ঠিক সেই সময়ে মহানবী সা. পাপাচার ও অনাচারে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিদের সামনে খুলে দিয়েছেন তওবার প্রশস্ত দ্বার। ব্যাপকভাবে ডেকেছেন তাদেরকে তাওবার দিতে।


পাঁচ. মানজিলে মাকসুদ:

মুহাম্মাদ সা. মানুষকে উপযুক্ত ও সম্মানজনক এক মানযিলের পথ দেখিয়েছেন। যেখানে ব্যয় হবে তার সমস্ত শক্তি। তিনি তাদেরকে সন্ধান দিয়েছেন বিশাল বিস্তৃত মহাশূন্যের, যেখানে সে উড়ে বেড়াবে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায়। নবীজির আগমনের আগে মানুষ নিজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। তারা জানতো না কোথায় যেতে হবে তাদেরকে এবং কোথায় শেষ হবে তাদের যাওয়া। ঠিক তখন আবির্ভূত হলেন রাসূলে আরাবী সা.। নির্ধারণ করে দিলেন মানুষের প্রকৃত লক্ষ্য। তিনি মানুষের মাঝে এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল করলেন, তাঁদের চেষ্টা-সাধনা, বোধ-বুদ্ধি, মেধা ও প্রতিভা, উচ্চাশা-আকাঙ্ক্ষা এবং স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও কেন্দ্রবিন্দু হলো আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তা। এটাই মানুষের আসল সৌভাগ্য, তার পূর্ণতার শেষ ধাপ, তার হৃদয় ও আত্মার মিরাজ।


পরিশেষে প্রাচ্যের কবি ড. ইকবালের একটি উচ্ছ্বল কবিতার মধ্যে রচনার ইতি টানছি, যেখানে তিনি মানবতার প্রতি মুহাম্মাদি নবুওয়াতের মহান অনুগ্রহকে মনমুগ্ধকর ভাষায় চিত্রিত করেছেন—

“তাঁর করকমলে লালিত হয় স্বাধীনতা, জাতির ‘আজ’ এসেছে তাঁর ‘গতকাল’ থেকে।

তিনি মানুষের দেহে হৃদয় রেখেছেন, মুখ থেকে সরিয়েছেন অবগুন্ঠন।

তিনি মিথ্যা খোদার পতন ঘটিয়েছেন, শুকনো শাখা তাঁর আর্দ্রতায় ছড়িয়েছে পত্র-পল্লব”।

1 মন্তব্যসমূহ

আপনার মন্তব্য লিখুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

নবীনতর পূর্বতন